ভূমিকম্প ঝুঁকিতে ঢামেকের শতবর্ষী ভবন
রাজধানীর অন্যতম প্রাচীন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল-১ (ঢামেক) ভবনটি ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। শতাধিক বছরের পুরোনো হাসপাতাল ভবনের অধিকাংশই ইটের দেয়াল দ্বারা নির্মিত। ভবনের বহু স্থানে ছাদ তৈরি করা হয়েছে রেললাইনের স্লিপার দিয়ে।
রোগীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধির ফলে পুরোনো রেল লাইনের স্লিপার দিয়ে ছাদের উপর বহু স্থানে সম্প্রসারণ কাজ করা হয়েছে। ফলে উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প হলে ধনী-গরিব নির্বিশেষে সুচিকিৎসার অন্যতম ভরসাস্থল এ প্রতিষ্ঠানটির ভবন ভেঙে পড়ে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছে বিশেষজ্ঞরা।
২০১০ সালে তৎকালীন হাসপাতাল পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল শহিদুল হক মল্লিক গণপূর্ত বিভাগকে দেয়া এক চিঠিতে আশঙ্কা প্রকাশ করে ভবনটি ঝুঁকিমুক্ত কি না তা সরেজমিন পরিদর্শন ও জরিপ করতে চিঠি দেন। প্রয়োজনে ভবনের আংশিক ভেঙে বিল্ডিং কোড অনুসরণ করে ভূমিকম্প প্রতিরোধে সক্ষম বহুতল ভবন নির্মাণ করা যায় কি না সে ব্যাপারে খসড়া কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের ব্যাপারে জানতে চান। এরপর জরিপ শুরু হলেও ভবনের কোন অংশ এখনও ভাঙা হয়নি।
সোমবার ভোরে রাজধানীসহ সারাদেশে ৬ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠলে নতুন করে সরকারি হাসপাতালে ভূমিকম্প পরবর্তী সময় চিকিৎসা প্রদানের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে। প্রথমেই অন্যতম বৃহৎ ঢামেক হাসপাতালের চিকিৎসা সক্ষমতা নিয়ে আলোচনা হয়।
ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞদের মতে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা মেগাসিটি ঢাকার অধিকাংশ ভবন ঝুঁকিপূর্ণ। দেশে ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হলে হাজার হাজার লোক হতাহত হবে। তাদের জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে চিকিৎসার প্রয়োজন হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢামেক হাসপাতালের এ ভবন নির্মাণের ইতিহাস বহু বছরের পুরোনো। বর্তমানে ডাক্তার, নার্স ও রোগীদের পদচারণায় ভবনটি মুখরিত থাকলেও এক সময় রাশভারি সরকারি আমলারা ভবনটিতে কাজ করতেন।
১৯০৪ সালে তৎকালীন ইস্টবেঙ্গল ও আসামের সচিবালয় ভবন হিসেবে নির্মিত হয় বর্তমান ঢামেক হাসপাতাল ভবন। পরে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে ভবনটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ওই সময় হাসপাতাল ভবনের একটি বড় অংশ ইউনিভার্সিটি মেডিকেল সেন্টার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া বাকি অংশ ছাত্রছাত্রীদের ডরমেটরি ও কলা ভবনের প্রশাসনিক কার্যক্রমে ব্যবহৃত হয়।
পরবর্তীকালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এ ভবনে একশ’ শয্যার আমেরিকান বেইজড হাসপাতাল হিসেবে যাত্রা শুরু হয়। ১৯৪৬ সালে এ ভবনে ঢামেক প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তী সময়ে মেডিকেল কলেজ পার্শ্ববর্তী ভবনে স্থানান্তরিত হলে ভবনটি হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু হয়।
বর্তমানে ঢামেক হাসপাতাল-১, ঢামেক হাসপাতাল-২ ও ঢামেক বার্ন ইউনিট মিলিয়ে ২৬শ’ বেডের হাসপাতাল পরিচালিত হচ্ছে। প্রতিদিন গড়ে আউটডোরে তিন থেকে চার হাজার রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন।
হাসপাতালের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে জানান, শতাব্দী পুরোনো এ ভবনটি যখন নির্মাণ করা হয় তখন সিমেন্টের প্রচলন ছিল না। ইটের সুরকির সাথে চুন মিশিয়ে দেয়াল আস্তর করা হতো। এখনকার মতো ছাদ ঢালাইয়ে উন্নতমানের রড ব্যবহার করা হতো না। তখন রেললাইনের স্লিপার বসিয়ে ছাদ নির্মিত হতো।
তারা বলেন, খালি চোখে হয়তো ভবনটির ক্রুটি ধরা পড়বে না। কিন্তু বাস্তবতা হলো বিভিন্ন সময় অপরিকল্পিত ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ কার্যক্রম করার ফলে তা ভূমিকম্প ঝুঁকিপ্রবণ হয়ে উঠেছে।
সরেজমিন পরিদর্শনকালে দেখা গেছে, ভবনটির নির্মাণ কাজ বর্তমান সময়ের নির্মাণ কাজ থেকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। তিন তলা এ ভবনের প্রতিটি ফ্লোরের ছাদ অনেক উপরে। কিছু কিছু ওয়ার্ডে লোহার স্লিপারের কিছু অংশ চোখে পড়ে। অনেক উঁচুতে রড ঝুলিয়ে ফ্যান চলার ব্যবস্থা করা হয়।
হাসপাতালের কর্মকর্তারা জানান- ইট, সুরকি ও চুন দ্বারা নির্মিত ভবনটিতে বিভিন্ন সময় সিমেন্ট দিয়ে প্লাস্টার করা হয়েছে। ফলে খালি চোখে মূল স্থাপনা দেখা যায় না।
এমইউ/এসকেডি/এসএইচএস/আরআইপি