তিস্তায় এবার মাত্র ১০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ প্রদানের সিদ্ধান্ত


প্রকাশিত: ০১:৩৩ পিএম, ০২ জানুয়ারি ২০১৬

নীলফামারীর দুই উপজেলার বাইরে সেচ ক্যানেলে পানি সরবরাহ না করার সিদ্ধান্তে চলতি বছর মাত্র ১০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ প্রদানের টার্গেট করা হয়েছে। পানি স্বল্পতার কারণে তিস্তা সেচ এলাকায় চলতি বছর মহাসঙ্কটে পড়তে পাড়ে পাউবো কর্তৃপক্ষ এমনই আশঙ্কা করা হচ্ছে।

একদিকে তিস্তার পানির ব্যাপক চাহিদা। আর অন্যদিকে উজানের পানি প্রবাহের উপর নির্ভরশীল উত্তরাঞ্চলের হাজার হাজার কৃষকের ভাগ্য সেচের উপর নির্ভরশীল।

সম্ভাবনা জাগিয়েও বারবার থেমে যাচ্ছে তিস্তা নদীর পানিবন্টন চুক্তি। আর এই চুক্তি বাস্তবায়নে যত দেরি হচ্ছে ততই হাহাকার বাড়ছে তিস্তা অববাহিকার লাখো মানুষের। সেচের সময় পানির অভাবে তিস্তা পাড়ের জমিগুলো ধু-ধু বালুচরে পরিণত হয়।

গত শনিবার তিস্তা নদীর পানির প্রবাহ ১ হাজার কিউসেকে এসে দাঁড়িয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়। দিন দিন নদীর পানি প্রবাহ হ্রাস পাওয়ায় গত বছরের চেয়ে চলতি রবি ও খারিপ-১ মৌসুমে তিস্তা ব্যারাজের মাধ্যমে সেচ প্রদানে জমির পরিমাণ ১৮ হাজার ৫ শত হেক্টর কমিয়ে আনা হয়েছে। ফলে এবার ১০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ প্রদানের টার্গেট সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সেচ মৌসুমে তিস্তা ব্যারাজের ক্যানেলের মাধ্যমে শুধুমাত্র নীলফামারীর ডিমলা, জলঢাকা, নীলফামারীর কিছু অংশে পানি সরবরাহ করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। গত বছর ২৮ হাজার ৫শ হেক্টর জমি সেচের টার্গেট করা হলেও পানি সল্পতার কারণে ৮ হাজার ৩২০ হেক্টর জমিতে সেচ সররবাহ করতে পেরেছে কর্তৃপক্ষ। ফলে সেচ ক্যানেলের ব্যাপক জমির ফলন নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি বিকল্প পদ্ধতিতে সেচ প্রদান করতে গিয়ে কৃষকের সেচের খরচ ২/৩ গুণ বেড়ে যায়।

২০১৪ সালে ৬৬ হাজার হেক্টর জমিতে পানি সরবরাহের টার্গেট করা হলে সেচ প্রদান করেছিল ২৫ হাজার ৫শ হেক্টর জমিতে। ২০১৫ সালে ৩৭ হাজার ৫ শত হেক্টর জমি কমিয়ে সেচ টার্গেট করা হয়েছিল ২৮ হাজার ৫শ হেক্টর জমিতে। কিন্তু তিস্তার পানি প্রবাহ ২শ কিউসেকে নিচে নেমে আসার কারণে মাত্র ৮ হাজার ৩২০ হেক্টর জমিতে সেচ দেয়া সম্ভব হয়েছিল।

একাধিক সূত্র জানায়, আপাতত তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, পশ্চিম দিনাজপুর, কোচবিহার ও মালদহ এলাকায় ভারত তাদের গজলডোবা ব্যারাজের মাধ্যমে সেচ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। সেখানে তাদের প্রচুর সেচ দিতে হয়। তার উপর তিস্তা নদীর উপর একাধিক জলবিদ্যুৎ প্রকল্প রয়েছে। ফলে তিস্তায় যে পরিমাণ পানি সিকিম থেকে নামছে তা পর্যাপ্ত নয়। যা ভারতের ওই সমস্ত এলাকায় চাহিদা মতো সেচ প্রদান সম্ভব হয় না। সেখানে বাংলাদেশে তিস্তার পানির পাওয়া বিষয়টি প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণে শুকনো মৌসুমে তিস্তার পানি প্রবাহ আশঙ্কাজনক ভাবে কমে যাচ্ছে। গত বছর পানি প্রবাহ ২শ কিউসেকের নিচে নেমে আসে।

নদী পাড়ের মানুষেরা জানান, নদী শুকিয়ে যাওয়ায় মৎসজীবীরা তাদের বাপ-দাদার পুরনো পেশা ছেড়ে শহরে গিয়ে হয়ে পড়েছে ছিন্নমূল। ছোট ছোট খেয়াঘাট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চরাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারে অচল হয়ে পড়েছে। নৌকাগুলো তুলে রাখতে বাধ্য হচ্ছে। সেই সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে রঙ্গিন পালের নৌকাগুলো।

অন্যদিকে নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় একটু বর্ষা হলেই দু`কুল ছাপিয়ে ফুঁসে ওঠছে তিস্তা। এর সাথে নদীর ভাঙনে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে লাখো মানুষ। এদিকে তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় তিস্তা অববাহিকার জেলে পরিবারগুলোর মাঝে দুর্ভোগ শুরু হয়েছে। নদী সংলগ্ন বাইশপুকুর গ্রামের রহিম উদ্দিন, রইছ উদ্দিন, খালিশা চাঁপানি গ্রামের বশির উদ্দিন, হামিদ, টেপাখড়িবাড়ির আছির উদ্দিন, পূর্ব ছাতনাইয়ের হারুনসহ অনেক জেলে জানায়, তিস্তা নদীতে পানি না থাকায় তারা এখন কর্মহীন হয়ে পড়েছে।

তারা জানায়, নদীতে যে পানি তাতে সারাদিন জাল ফেলে ৫০ টাকার মাছ ধরা যায় না। এতে করে পরিবার-পরিজন নিয়ে চরম কষ্টের মধ্যে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। নদীর পানি কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাছও কমে গেছে তাই অনেকে এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যাচ্ছেন বলে জানান তারা।

তিস্তা ব্যারেজ সেচ প্রকল্পের সম্প্রসারণ কর্মকর্তা রাফিউল বারী জাগো নিউজকে জানান, চলতি রবি ও খরিপ-১ মৌসুমে তিস্তা ব্যারেজ থেকে আগামী ৫ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে সেচ প্রদান শুরু করা হবে। কিন্তু উজানের প্রবাহ দিন দিন কমে আসায় তিস্তা নদীর পানি শুকিয়ে যাচ্ছে। ফলে তিস্তা ব্যারেজের কমান্ড এলাকায় সম্পূরক সেচ কার্যক্রম পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়ছে।

তিনি জানান, ২০১৪ সালে সেচ নির্ভর রবি ও খরিপ-১ মৌসুমে নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলায় ৬৫ হাজার ৫শত হেক্টর জমিতে সেচ প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা ছিল, কিন্তু সেখানে তিস্তা নদীর পানি অভাবে সেচ প্রদান সম্ভব হয়েছিল মাত্র ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে। ২০১৫ সালে ৩৭ হাজার ৫শত হেক্টর জমি সেচের আওতা থেকে কমিয়ে আনা হয়েছিল ২৮ হাজার ৫শ হেক্টর জমিতে। কিন্তু পানি কম থাকার কারণে সেচ সরররাহ করা হয়েছে ৮ হাজার ৩২০ হেক্টর জমিতে।

তিনি বলেন, যেহেতু এখনও তিস্তার পানি চুক্তি হয়নি সে ক্ষেত্রে গত বছরের ন্যায় চলতি বছরেও তিস্তা নদীর পানির প্রাপ্তিতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ফলে এবার রবি ও খরিপ-১ মৌসুমে (সেচ নির্ভর বোরো) আবাদের সেচ প্রদানের জন্য ১০ হাজার হেক্টর জমির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। নীলফামারীর ডিমলায় সাড়ে ৩ হাজার হেক্টর, জলঢাকা ৬ হাজার হেক্টর ও নীলফামারীর কিছু অংশে ৫শ হেক্টর।

এ ক্ষেত্রে সেচ প্রদান সম্ভব হবে না নীলফামারীর ১৮ হাজার ৫শ, দিনাজপুর জেলার ২০ হাজার ও রংপুর জেলার ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে।

গত বৃহস্পতিবার রংপুর তিস্তা ভবনে প্রধান প্রকৌশলী আতিকুর রহমানের সভাপতিত্বে সেচ প্রদানের বিষয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকের তিস্তার পানি প্রবাহ কম থাকায় চলতি মৌসুমে ১০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সরবরাহের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডালিয়া ব্যারেজের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, গত বছর পানি কম থাকার কারণে তিস্তার কমান্ড এলাকায় চলতি বছর ১০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ প্রদানের টার্গেট করা হয়েছে। পানি বেশি পাওয়া গেলে সেচ টার্গেট বৃদ্ধি করা হবে।

জাহেদুল ইসলাম/এমএএস/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।