‘দেশে বছরে ৩০০ কোটি টাকার ভেজাল ওষুধ তৈরি হয়’
নকল, ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ চক্রের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে রাজধানীতে মানববন্ধন করেছে কয়েকটি সংগঠন। মানববন্ধনে ‘দেশে বছরে ৩০০ কোটি টাকার ভেজাল ওষুধ তৈরি হয়’ বলে জানানো হয়।
ভেজাল ওষুধের ফলে রোগীর স্বাস্থ্যঝুঁকি ও প্রাণহানির ঘটনাও ধীরে ধীরে বেড়েই চলছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনসহ (পবা) সমমনা ১০টি সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে শনিবার (৪ ডিসেম্বর) শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে ‘নকল, ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ চক্রের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই’ দাবিতে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে ও সম্পাদক এম এ ওয়াহেদের সঞ্চালনায় মানববন্ধনে বক্তব্য দেন পবার সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান, মানবাধিকার উন্নয়ন কেন্দ্রের মহাপরিচালক মাহবুল হক, সামাজিক শক্তির সভাপতি মো. হাবিব উল্লাহ, বাংলাদেশ ট্যুরিস্ট সাইক্লিস্টের প্রধান সমন্বয়ক রোজিনা আক্তার, পুরান ঢাকা নাগরিক উদ্যোগের সভাপতি নাজিমউদ্দীন প্রমুখ।
বক্তারা বলেন, দেশে বর্তমানে প্রায় ৩০০টি ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে মাত্র ৩ শতাংশ ওষুধ আমদানি করতে হয় আর ৯৭ শতাংশ অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থেকেই দেশের চাহিদা মেটানো হচ্ছে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে ১৫৭টি দেশে বাংলাদেশ ওষুধ রপ্তানি করে। কিন্তু কিছু লাইসেন্সধারী ও লাইসেন্সবিহীন কোম্পানি অধিক মুনাফার জন্য ভেজাল ওষুধ তৈরি ও বাজারজাত করছে, যা মানুষের যেমন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে তার চেয়ে বেশি শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বিবিসি নিউজে প্রকাশিত তথ্য মতে, বাংলাদেশে বছরে উৎপাদন হয় ২৫ হাজার ধরনের ওষুধ, এর মধ্যে মাত্র চার হাজার ওষুধ পরীক্ষা করে দেখার সামর্থ্য আছে সরকারের। এর দু-তিন শতাংশ ওষুধ ভেজাল, নকল বা নিম্নমানের। বাকি ২১ হাজার ওষুধ কখনো পরীক্ষাই করা হয় না।
বক্তারা আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে ওষুধ-শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে মোট উৎপাদিত ওষুধের অন্তত দুই শতাংশ অর্থাৎ প্রতি বছর ৩০০ কোটি টাকার বেশি পরিমাণ অর্থের ভেজাল, নকল ও নিম্নমানের ওষুধ তৈরি হয়। নামে-বেনামে বিভিন্ন কোম্পানি ভেজাল ওষুধ বাজারজাত করে। অনেক সময় এসব ওষুধে উৎপাদন ও মেয়াদের শেষ তারিখ থাকে না।’ ঔষধ আইন ১৯৪০ ও জাতীয় ঔষধ নীতি ২০১৬ যথাযথ বাস্তবায়নের দাবি জানান বক্তারা।
তারা আরও বলেন, ‘প্রয়োজন হলে আইন সংশোধন করে কঠোর শাস্তির বিধান করতে হবে, যাতে কেউ এ ধরনের মানবতাবিধ্বংসী কাজ করার সাহস না পায়। প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার পাশাপাশি ওষুধ শিল্প সমিতিরও এ ব্যাপারে ভূমিকা রাখতে হবে।’ অভিজ্ঞ চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ভালো কোম্পানির ওষুধ লেবেলের নাম, মূল্য ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ ইত্যাদি দেখে ভোক্তাদের ওষুধ কেনারও আহ্বান জানান তারা।
‘দেশে বিভিন্ন সময় পরিচালিত অভিযানে নকল ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদনকারীদের গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। কিন্তু তারপরও বন্ধ হচ্ছে না নকল ওষুধ উৎপাদন ও বিক্রি। দুর্বল আইনের কারণে নকল ওষুধ তৈরিতে ভয় পান না তারা। ড্রাগস আইনে নকল ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদনকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান আছে ১০ বছরের কারাদণ্ড। বিশেষ ক্ষমতা আইনে মৃত্যুদণ্ডের বিধানও রয়েছে। তবে মামলা হওয়ার পর তদন্তকারী কর্মকর্তাদের প্রভাবিত ও আর্থিক শক্তি ব্যবহার করে সবকিছু তাদের অনুকূলে নিয়ে যায়।’
‘বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নকল ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদন ও বিপণনের সঙ্গে জড়িতরা গণহত্যার মতো অপরাধ করছে। আমরা বলতে চাই, এই গণহত্যা এখনই থামাতে হবে। আমরা দেখতে চাই, নকল ও ভেজাল ওষুধ উৎপাদন ও বিপণনের সঙ্গে জড়িত সব ঘটনার বিচার হচ্ছে, অপরাধীরা সাজা পাচ্ছে ও সাজা ভোগ করছে। আইনের ফাঁকফোকর গলে তারা যেন বের হয়ে না আসতে পারে সেটা নিশ্চিত করতে হবে।’ জনস্বাস্থ্যের মারাত্মক হুমকির জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি বদলাবে না বলে জানান বক্তারা।
তারা বলেন, ‘জনসাধারণের স্বাস্থ্য-সুরক্ষায় ওষুধ প্রয়োজন। কিন্তু সেই ওষুধ যদি জীবনরক্ষার পরিবর্তে ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনে তাহলে দুর্ভোগের সীমা থাকে না। বিশ্ববাজারে যখন বাংলাদেশের উৎপাদিত ওষুধের চাহিদা বেড়েই চলেছে ঠিক তখনই এর বিপরীত চিত্র দেশের বাজারে। দেশে উৎপাদন হচ্ছে ভেজাল ও নকল ওষুধ, যার ফলে ধীরে ধীরে অস্থির হয়ে উঠছে ওষুধ-শিল্প ও চিকিৎসা ব্যবস্থা। ভেজাল ও নকল ওষুধ শিল্পের উন্নয়ন ও প্রসারে এক বিরাট অশনি সংকেত। পরিসংখ্যান মতে, দেশীয় বাজারে ভেজাল ও নকল ওষুধের বার্ষিক বিক্রয় প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার উপরে। এই বিরাট অংকের ভেজাল ওষুধের বিক্রি থেকে সহজে অনুমান করা যায়, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের উৎপাদিত ওষুধের সুনাম থাকলেও দেশীয় বাজারে চলছে চরম অনিয়ম ও দুর্নীতি।’
এমওএস/এআরএ/জেআইএম