তিন বছরে ২০ এমপি হারিয়েছে সংসদ, করোনায় অনেকে পাননি জানাজাও
চলমান একাদশ জাতীয় সংসদের প্রায় তিন বছরে ২০ জন সংসদ সদস্যকে হারিয়েছে জাতীয় সংসদ। তাদের মধ্যে পাঁচজন প্রাণ হারিয়েছেন করোনায়। মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে ১৮ জনই আওয়ামী লীগের এমপি। দুজন অন্যান্য দলের। করোনাকাল হওয়ায় অনেক এমপি সংসদে জানাজাও পাননি।
সর্বশেষ মঙ্গলবার (১৬ নভেম্বর) সংসদের টাঙ্গাইল-৭ (মির্জাপুর) আসনের টানা চারবারের সংসদ সদস্য, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মো. একাব্বর হোসেন মারা গেলেন।
২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের (৩০ ডিসেম্বর) পর এ পর্যন্ত সংসদ সদস্যদের মৃত্যুর রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে।
জাতীয় সংসদের তথ্য অনুযায়ী, গত সংসদের পাঁচ বছরে ১৫ জন এমপি মারা যান। কিন্তু চলতি সংসদের দুই বছরেই এ সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে। বর্তমান সংসদের মেয়াদ আরও দুই বছর এখনো বাকি।
এই স্বল্প সময়ে এতজন সংসদ সদস্যকে হারিয়ে আবেগাপ্লুত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দলের নেতারা। এজন্য তারা সংসদে কান্নাকাটিও করেছেন।
সংসদ সদস্যদের মৃত্যুর কারণে তাদের আসন খালি হয়েছে। করোনার কারণে সেসব আসনে উপ-নির্বাচন দিতেও দেরি হয়েছে।
সংসদের আইন শাখা-২ সূত্র জানায়, নির্বাচনের ঠিক পরপরই আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম (কিশোরগঞ্জ-১) মারা যান। তিনি চলতি সংসদের একটি অধিবেশনেও যোগ দিতে পারেননি। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে তিনি মারা যান। এমনকি এমপি হিসেবে শপথও নেননি তিনি। তবে এমপি হিসেবে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল নির্বাচন কমিশন।
তার মৃত্যুতে সংসদের প্রথম অধিবেশনের প্রথম কার্যদিবসে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেন, সৈয়দ আশরাফ অত্যন্ত সৎ ও মেধাবী রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। রাজনৈতিক জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও অসাধারণ মেধাসম্পন্ন নেতা ছিলেন সৈয়দ আশরাফ। তিনি আমার পরিবারের সদস্যদের মতো ছিলেন, আমাকে বড় বোনের মতো শ্রদ্ধা করতেন। তাকে নিজের ভাইয়ের মতোই দেখতাম।
এছাড়া একই বছরের ৯ জুলাই আওয়ামী লীগের রুশেমা বেগম (মহিলা আসন-৩৪), ১৪ জুলাই জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ (রংপুর-৩) মারা যান।
এরশাদের মৃত্যুতে সংসদে আনা শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে তার সহধর্মিণী রওশন এরশাদ আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, তিনি (এরশাদ) অনেক জনদরদি নেতা ছিলেন। উনি দেশ ও জনগণের জন্য অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় যে কাজ অসমাপ্ত রেখে গিয়েছিলেন, তার অকাল ও মর্মান্তিক মৃত্যুতে তিনি যা শেষ করে যেতে পারেননি, এইচ এম এরশাদ তা সম্পন্ন করার চেষ্টা করেন।
এছাড়া ওই বছরের ৭ নভেম্বর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের কার্যকরী সভাপতি মঈন উদ্দীন খান বাদল (চট্টগ্রাম-৮), ২৭ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের মো. ইউনুস আলী সরকার (গাইবান্ধা-৩) মারা যান।
২০২০ সালে মারা যান যারা
২০২০ সালের ১০ জানুয়ারি মারা যান আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মোজাম্মেল হোসেন (বাগেরহাট-৪), ১৮ জানুয়ারি আব্দুল মান্নান (বগুড়া-১), ২১ জানুয়ারি ইসমাত আরা সাদেক (যশোর-৬), ২ এপ্রিল ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলু (পাবনা-৪, আটঘরিয়া-ঈশ্বরদী), ৬ মে হাবিবুর রহমান মোল্লা (ঢাকা-৫, ডেমরা-দনিয়া-মাতুয়াইল)। করোনায় আক্রান্ত হয়ে ১৩ জুন মারা যান সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ নাসিম (সিরাজগঞ্জ-১, কাজিপুর), ১০ জুলাই সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন (ঢাকা-১৮) ও ২৭ জুলাই ইসরাফিল আলম (নওগাঁ-৬)।
একের পর এক এমপি মারা যাওয়ায় জুনে সংসদে অশ্রুসিক্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘খুব দুঃখজনক…আসলে আমার জন্য খুব কষ্টকর হচ্ছে বলতে, এভাবে সবাইকে হারানো খুবই দুঃখজনক।’
প্রাণঘাতী করোনায় আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ও ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মো. আবদুল্লাহ (এমপি নন) মারা যাওয়ায় সংসদে আনীত শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনা করতে গিয়ে বার বার তিনি চোখ মোছেন।
২০২১ সালে যাদের মৃত্যু হয়েছে
মো. একাব্বর হোসেন ছাড়াও গত ১১ মার্চ মারা যান সিলেট-৩ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী। ৪ এপ্রিল মারা যান ঢাকা-১৪ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আসলামুল হক। ১৪ এপ্রিল মারা যান সাবেক আইনমন্ত্রী ও কুমিল্লা-৫ আসনের সংসদ সদস্য আব্দুল মতিন খসরু। ৩০ জুলাই মারা যান কুমিল্লা-৭ আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক ডেপুটি স্পিকার অধ্যাপক মো. আলী আশরাফ, ২ সেপ্টেম্বর মারা যান সিরাজগঞ্জ-৬ আসনের সংসদ সদস্য হাসিবুর রহমান স্বপন এবং জাতীয় পার্টির (জাপা) সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য অধ্যাপক মাসুদা এম রশিদ চৌধুরী ১৩ সেপ্টেম্বর মারা যান।
জাতীয় সংসদে আবদুল মতিন খসরু ও আসলামুল হকসহ বিশিষ্ট ব্যক্তির নামে শোক প্রস্তাবের আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আসলে জীবনটাই হয়ে গেছে এমন, কে যে কখন আছে, কে যে কখন নাই, তার কোনো হিসাবই নেই।
গত বছরের জানুয়ারির পর মৃত্যুবরণকারী কোনো সংসদ সদস্যরই সংসদ ভবনে জানাজা হয়নি। অথচ কোনো এমপি মারা গেলে সংসদে অনুষ্ঠিত জানাজায় রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার ছাড়াও নিজ নিজ দলের পক্ষ থেকে মরদেহে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানানো হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা হলে পান গার্ড অব অনার। জানাজায় সহকর্মীরা ছাড়াও সংসদে কর্মরত ও আশপাশ এলাকায় বসবাসকারীরা অংশ নেন। কিন্তু করোনা মহামারিতে মারা যাওয়া এমপিদের ভাগ্যে এসব জোটেনি। তবে করোনার প্রকোপ কমে যাওয়ায় জাতীয় সংসদ ছাড়াও একাব্বর হোসেনের জানাজা হবে বিভিন্ন জায়গায়।
করোনায় মারা গেছেন যারা
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন শতাধিক সংসদ সদস্য। তবে তাদের বেশিরভাগ সুস্থ হয়ে উঠলেও ঘাতক করোনা প্রাণ কেড়ে নিয়েছে বর্তমান সংসদের চার সদস্যের। সংসদ সদস্যদের মধ্যে সর্বপ্রথম করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে মারা যান সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও সিরাজগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ নাসিম। এরপর মারা যান নওগাঁ-৬ আসনের এমপি ইসরাফিল আলম। করোনার টিকার প্রথম ডোজ নেওয়ার পরও আক্রান্ত হয়ে মারা যান সিলেট-৩ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী। এছাড়া সাবেক আইনমন্ত্রী ও কুমিল্লা-৫ আসনের সংসদ সদস্য আব্দুল মতিন খসরু করোনায় মারা যান।
বিগত সংসদে যে ১৫ এমপির মৃত্যু
বিগত দশম জাতীয় সংসদের পাঁচ বছরে দুজন মন্ত্রী, একজন প্রতিমন্ত্রী ও একজন বিরোধীদলীয় হুইপসহ ১৫ জন এমপি মারা যান। তাদের মধ্যে ১২ জন আওয়ামী লীগের। তিনজন জাতীয় পার্টির এমপি ছিলেন। এদের মধ্যে হত্যা করা হয়েছে এক সংসদ সদস্যকে। একই আসনে মারা গেছেন দুই সংসদ সদস্য।
দশম সংসদের ২৩টি অধিবশন শুরুর দিন উত্থাপিত শোক প্রস্তাবের বই এবং সংসদ লাইব্রেরিতে রাখা সংসদের কার্যপ্রবাহ থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সংসদের আইন শাখা-২ সূত্রে জানা যায়, দশম সংসদ হারিয়েছে সুনামগঞ্জ-২ আসন থেকে নির্বাচিত বর্ষীয়ান পার্লামেন্টারিয়ান ও বিশিষ্ট তার্কিক সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে। তিনি একসময় এ সরকারের রেলমন্ত্রীও ছিলেন। এছাড়া মন্ত্রীদের মধ্যে রয়েছেন সৈয়দ মহসিন আলী (মৌলভীবাজার-৩), মোহাম্মদ ছায়েদুল হক (ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১) এবং প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিন (ময়মনসিংহ-১)।
প্রতিমন্ত্রী মর্যাদার বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ কুড়িগ্রাম-২ আসনের জাতীয় পার্টির এমপি মো. তাজুল ইসলাম চৌধুরীকে হারায় এ সংসদ। মারা যাওয়া আওয়ামী লীগের অন্য এমপিদের মধ্যে রয়েছেন গাইবান্ধা-১ আসনের মো. মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন। ২০১৬ সালের শেষ প্রহরে নিজ বাড়িতে নির্মমভাবে তাকে হত্যা করা হয়। ওই আসনের উপ-নির্বাচনে এমপি হন একই দলের গোলাম মোস্তফা আহমদ। সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনিও মারা যান।
এছাড়া সিরাজগঞ্জ-৩ আসনের মো. ইসহাক হোসেন তালুকদার, মাগুরা-১ আসনের মোহাম্মদ সিরাজুল আকবর, খুলনা-৪ আসনের এস এম মোস্তফা রশদি, বরিশাল-৫ আসনের মো. শওকত হোসেন, টাঙ্গাইল-৮ আসনের শওকত মোমেন শাহজাহান, ময়মনসিংহ-৩ আসনের মজিবুর রহমান ফকির ইন্তেকাল করেন।
জাতীয় পার্টির কুড়িগ্রাম-৩ আসনের এ কে এম মাঈদুল ইসলাম এবং নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের মো. নাসিম ওসমান মারা যান। প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদার বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ কুড়িগ্রাম-২ আসনের এমপি মো. তাজুল ইসলাম চৌধুরীকে হারায় ওই সংসদ।
এইচএস/ইএ/এএসএম