হবিগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জের রাজাকারের বিরুদ্ধে সাত অভিযোগ
মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর পালাতক সাবেক মুসলিম লীগ নেতা হবিগঞ্জ জেলার লাখাই উপজেলার মো. লিয়াকত আলী (৬১)ও কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রাম উপজেলার আমিনুল ইসলাম (৬২) ওরফে রজব আলীর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা।
রোববার দুপুরে রাজধানীর ধানমন্ডির তদন্ত সংস্থার প্রধান কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এসময় তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান খান, সিনিয়র সমন্বয়ক সানাউল হক ও তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. নূর হোসেন উপস্থিত ছিলেন।
বর্তমানে হবিগঞ্জ জেলার লাখাই উপজেলার এক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মুসলিম লীগের সাবেক সভাপতি মো. লিয়াকত আলী আমেরিকায় এবং রজব আলী দেশেই পলাতক আছেন বলে জানান কর্মকর্তারা।
তারা দুজনে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাশাপাশি তিন জেলার (হবিগঞ্জ জেলার লাখাই, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর ও কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামে) বিভিন্ন অপরাধ করেছেন। তদন্তে দুই জনের বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, আটক, অপহরণ, নির্যাতন ও লুটপাটের সাতটি অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে।
৩শ’ ১৩ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে ১শত ৭৯ পৃষ্ঠার দালিলিক প্রমাণ, ৭২ পৃষ্ঠার মূল প্রতিবেদন এবং ৬২ পৃষ্ঠার সাক্ষীদের জবানবন্দি রয়েছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) মো. নূর হোসেন ২০১৪ সালের ৫ নভেম্বর থেকে ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত তদন্ত করেছেন। মামলায় মূল সাক্ষী ২৭ জন ও জব্দ তালিকার আরও ২ জনসহ মোট ২৯ জন সাক্ষী রয়েছে বলে জানানো হয়।
আসমিদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো নিন্মরূপ;
প্রথম অভিযোগ : ১৯৭১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ভোর ৫টা থেকে বেলা পৌনে দুইটা পর্যন্ত লিয়াকত আলী, আমিনুল ইসলাম ও তার সঙ্গীরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীদের সঙ্গে নিয়ে লাখাই থানার কষ্ণপুর গ্রামে অভিযান চালিয়ে গণহত্যা ও লুটপাট করে। নুপেন রায়ের বাড়িতে রাধিকা মোহন রায় ও সুনীল শর্মাসহ ১৫ জন জ্ঞাত ও ২৮ জন অজ্ঞাত হিন্দুকে গুলি করে হত্যা করে।
দ্বিতীয় অভিযোগ : ১৯৭১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর বেলা ২টা থেকে বেলা পৌনে ৩টা পর্যন্ত লিয়াকত আলী, আমিনুল ইসলাম ও তার সঙ্গীরা পাকিস্তানিদের সঙ্গে নিয়ে চন্ডিপুর গ্রামে চন্দ্র কুমার ও জয়কুমারসহ ৯জন হিন্দু লোককে গুলি করে হত্যা করে এবং গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে লুটপাট করে।
তৃতীয় অভিযোগ : ১৯৭১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর বেলা ৩টার দিকে লাখাই থানার গদাইনগর গ্রামে লিয়াকত আলী, আমিনুল ইসলাম ও পাকিস্তানি আর্মি কর্তৃক চিত্ত রঞ্জন দাসের বাড়ির বাইরের আঙ্গিণায় জগদ্বীশ দাস, পিয়ারি দাস ও মহাদেবমাসসহ ২৬ জ্ঞাত অজ্ঞাত আরও ৭/৮ জন আহত হয়ে বেঁচে যাঁন।
চতুর্থ অভিযোগ : ১৯৭১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর লিয়াকত আলী, আমিনুল ইসলাম পাকিস্তানি আর্মীদের সঙ্গে নিয়ে কৃষ্ণপুর এলাকায় অভিযান চালানোর সময় হরিদাস রায় ও খিতিস রায়সহ ১০ জন হিন্দু লোককে অপহরণ করে অষ্টগ্রাম থানার সদানগর গ্রামের শ্মশানঘাটে এনে রাত ১০টার দিকে আর্মিরা তাদেরকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুলি ও বেয়নেট চার্জ করে। এতে ঘটনাস্থলে ৮ জন মারা যান এবং ২ জন আহত হয়ে বেঁচে যান।
পঞ্চম অভিযোগ : লিয়াকত আলী, আমিনুল ইসলাম ও তার সঙ্গীরা ৭১ সালের ভাদ্র মাসের প্রথম সপ্তাহে যে কোন দিন বেলা ১০টার দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসির নগর থানার ফান্দাউক বাজার থেকে রঙ্গু মিয়া ও বাচ্চু মিয়াকে অপহরণ করে নিয়ে রাজাকার ক্যাম্পে টর্চার সেলে নিয়ে নির্যাতন করে। পরের দিন বেলা ১২টার দিকে রঙ্গু মিয়াকে নাসির নগর থানাধীন ডাকবাংলোর পাশে দত্তবাড়ির খালে হত্যা করে লাশ পানিতে ফেলে দেয়। অপহৃত বাচ্চু মিয়া অর্থের বিনিময়ে রাজাকারদের হাত থেকে মুক্তি পান।
ষষ্ঠ অভিযোগ : ১৯৭১ সালের ৭ নভেম্বর বেলা আনুমানিক ১২টার সময় লিয়াকত আলী, আমিনুল ইসলাম, রাজাকার ও পাকিস্তানি সঙ্গীদের নিয়ে অষ্টগ্রাম থানার সাবিয়ানগর গ্রামে চৌধুরী বাড়ির উত্তর পাশে খালি জায়গায় ইশা খা ও আরজু ভূইয়াসহ ৫ জনকে গুলি করে হত্যা করে।
সপ্তম অভিযোগ : ১৯৭১ সালের ৭ নভেম্বর বেলা আনুমানিক ১২টা থেকে সাড়ে ১২টার দিকে লিয়াকত আলী, আমিনুল ইসলাম, রাজাকার ও পাকিস্তানি সঙ্গীদের নিয়ে অষ্টগ্রাম থানার সাবিয়ানগর গ্রামে খাঁ বাড়িতে অভিযান চালিয়ে মনির খাঁ ও সফর আলীসহ আওয়ামী লীগ ও স্বাধীনতাকামী ১০ জনকে গুলি করে হত্যা করে। ওই সময় রাজাকাররা বাড়িতে লুটপাট করে। এসব ঘটনায় ১৯৭২ সালে আমিনুল ইসলাম ওরফে রজব আলীর বিরুদ্ধে অষ্টগ্রাম থানায় তিনটি মামলা করা হয়। ওই সব অভিযোগে তার যাবতজীবন দণ্ড হয়েছিল।
এফএইচ/এসকেডি/আরআইপি