৫০০ জনকে দুবাই পাচার করেছে মানবপাচার চক্রটি
বেশি বেতনে চাকরির প্রলোভনে দুবাই যাওয়ার জন্য প্রলুব্ধ করে একটি মানবপাচার চক্র। ভিকটিম দুবাই যেতে রাজি হলে দুই থেকে তিন লাখ টাকার বিনিময়ে তাদেরকে ভ্রমণ ভিসায় দুবাই নিয়ে যায়। ভ্রমণ ভিসায় যাওয়ার পর কেউ কেউ কাজের সুযোগ পেলেও অধিকাংশই কাজ না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করে। এভাবে চক্রটি সাত বছর ধরে পাঁচ শতাধিক ভিকটিমকে দুবাই পাচার করেছেন।
এছাড়াও মানবপাচারকারী চক্রটি নকল বিএমইটি ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড তৈরি করে ভিকটিমদের সরবরাহ করতেন। নকল কার্ড নিয়ে ভিকটিমরা বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন করতে গেলে কর্তব্যরত জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর সদস্যরা ভিকটিমদের ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড নকল হিসেবে শনাক্ত করেন ও ভিকটিমদের বিদেশযাত্রা স্থগিত করেন।
এসব অভিযোগের ভিত্তিতে শুক্রবার (৫ নভেম্বর) রাত থেকে শনিবার (৬ নভেম্বর) সকাল পর্যন্ত রাজধানীর তুরাগ, উত্তরা, রমনা, পল্টন ও কসবা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে মানবপাচার চক্রের মূলহোতাসহ আটজনকে গ্রেফতার করে র্যাব-৩।
গ্রেফতাররা হলেন- চক্রের মূলহোতা মো. নাইম খান ওরফে লোটাস (৩১), মো. নুরে আলম শাহরিয়ার (৩২), মো. রিমন সরকার (২৫), মো. গোলাম মোস্তফা সুমন (৪০), মো. বদরুল ইসলাম (৩৭), মো. খোরশেদ আলম (২৮), মো. সোহেল (২৭), ও মো. হাবিব (৩৯)।
এসময় তাদের কাছ থেকে ১৪টি পাসপোর্ট, ১৪টি নকল বিএমইটি কার্ড, একটি সিপিইউ, একটি প্রিন্টার, একটি স্ক্যানার, পাঁচটি মোবাইল ফোন, একটি চেকবই ও পাঁচটি নকল সিল জব্দ করা হয়।
শনিবার (৬ নভেম্বর) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন র্যাব-৩ এর অধিনায়ক (সিও) লে. কর্নেল রাকিবুল হাসান।
তিনি বলেন, কয়েকজন ভিকটিম র্যাব-৩ এ অভিযোগ করেন যে, একটি চক্র তাদেরকে ভ্রমণ ভিসায় মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে পাঠাতে চেয়েছিলেন। তবে ভিকটিমরা বিএমইটি ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড ছাড়া অবৈধভাবে বিদেশ যেতে অস্বীকৃতি জানিয়ে টাকা ফেরত চান। তখন চক্রটি নকল বিএমইটি ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড তৈরি করে ভিকটিমদের সরবরাহ করেন। নকল কার্ড নিয়ে ভিকটিমরা বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন করতে গেলে কর্তব্যরত জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর সদস্যরা তাদের কার্ড নকল হিসেবে শনাক্ত করেন এবং বিদেশযাত্রা স্থগিত করেন। পরে ভিকটিমরা দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা কোনো সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেননি। একপর্যায়ে তারা ভিকটিমদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন।
র্যাব-৩ এর অধিনায়ক বলেন, গ্রেফতার নাইম খান ওরফে লোটাস চক্রের মূল হোতা। সে দুবাই প্রবাসী। চলতি বছরের মে মাসে সে দেশে ফেরত আসে। তার শিক্ষাগত যোগ্যতা এইচএসসি পাশ। ২০১২ সালে ওয়ার্কপারমিট নিয়ে দুবাই গমন করে। পরবর্তীতে দুবাই সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ থেকে শ্রমশক্তি আমদানি করা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু দুবাই শ্রম বাজারে বাংলাদেশি শ্রমিকদের চাহিদা থাকায় দুবাইয়ের কিছু প্রতিষ্ঠান ভ্রমণ ভিসায় দুবাই অবস্থানকারীদের ওয়ার্কপারমিট দিয়ে কাজের বৈধতা দেয়। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নাইম মানবপাচারে জড়িয়ে পড়ে। দুবাইয়ে ও বাংলাদেশে তার পরিচিতজনদের মাধ্যমে ভিক্টিমদের উচ্চ বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে দুবাই যাওয়ার জন্য প্রলুব্ধ করে। ভিক্টিম রাজি হলে দুই থেকে তিন লাখ টাকার বিনিময়ে সে তাদেরকে ভ্রমণ ভিসায় দুবাই নিয়ে থাকে।
ভিক্টিমরা ভ্রমণ ভিসায় যাওয়ার পর কেউ কেউ কাজের সুযোগ পেলেও অধিকাংশই কাজ না পেয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করে। এভাবে সে সাত বছর ধরে পাঁচ শতাধিক ভিক্টিমকে দুবাই পাচার করেছে। মানবপাচার থেকে অর্জিত অবৈধ উপার্জন দিয়ে সে দুবাইয়ে নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন নেয় ও নিজে রেসিডেন্স ভিসার অনুমোদন নেয়।
নাইমকে তার সহযোগীদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে জানায়, দুবাইয়ে ফারুক নামে তার একজন সহকারী রয়েছে ও নুরে আলম শাহরিয়ার বাংলাদেশে তার মূল সহযোগী হিসেবে কাজ করে। শাহরিয়ার ভিক্টিমদের যাবতীয় প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি করে দেয়। শাহরিয়ারের ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার কসবায় কম্পিউটার কম্পোজ ও ফটোকপির দোকান রয়েছে। সে ব্রাহ্মণবাড়ীয়া থেকেই ভিক্টিমদের সঙ্গে যোগাযোগ করে থাকে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে কিছু ভিক্টিম বিএমইটি ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড ছাড়া বিদেশ যেতে অস্বীকৃতি জানালে শাহরিয়ারের মাধ্যমে বিএমইটি কার্ড জালিয়াত চক্র ওই মানবপাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত হয়।
র্যাব-৩ এর সিও রাকিবুল হাসান বলেন, বিএমইটি কার্ড জালিয়াত চক্রের মূলহোতা হাবিব ও খোরশেদ। তারা দীর্ঘদিন ধরে অত্যন্ত গোপনে নিজেদের আড়ালে রেখে বিশ্বস্তজনের মাধ্যমে ভিকটিমদের নকল বিএমইটি কার্ড সরবরাহ করে আসছে। দীর্ঘদিন ধরে নাইম বিএমইটি কার্ড ছাড়াই মানবপাচার করে আসছেন। ভিকটিমরা বিএমইটি কার্ড দাবি করলে শাহরিয়ার তার চাচা গোলাম মোস্তফা সুমনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তখন সুমন জানায়, ১৫ হাজার টাকার বিনিময়ে একটি বিএমইটি কার্ড দিতে পারবেন। নাইম ভিকটিমদের বিএমইটি কার্ড সংগ্রহ করার জন্য শাহরিয়ারের মাধ্যমে ১৩টি পাসপোর্ট সুমনের কাছে হস্তান্তর করেন। সুমন সাত হাজার টাকার বিনিময়ে একটি বিএমইটি কার্ড হিসেবে গ্রেফতার বদরুলের কাছে হস্তান্তর করেন।
‘বদরুল এক হাজার টাকার বিনিময়ে একটি বিএমইটি কার্ড হিসেবে খোরশেদের কাছে হস্তান্তর করেন। খোরশেদ ৬৫০ টাকার বিনিময়ে একটি বিএমইটি কার্ড হাবিবের কাছে হস্তান্তর করেন। হাবিব পাসপোর্টের তথ্য ব্যবহার করে জাল বিএমইটি কার্ড তৈরি করেন। এরপর জাল বিএমইটি কার্ড খোরশেদ ও বদরুলের হাত হয়ে সুমনের কাছে পৌঁছায়। গ্রেফতার রিমন সরকার শাহরিয়ারের নির্দেশে জাল বিএমইটি কার্ড সুমনের কাছ থেকে সংগ্রহ করে নাইমের কাছে পৌঁছে দেন। নাইম ফ্লাইটের আগে ভিকটিমদের কাছে জাল বিএমইটি কার্ড সরবরাহ করেন।’
লে. কর্নেল রাকিবুল আরও বলেন, ‘সোহেল স্থানীয় দালাল হিসেবে কাজ করেন। জাল বিএমইটি কার্ড তৈরির প্রক্রিয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদে হাবিব জানিয়েছে, তিনি মহসিন নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে খালি কার্ড কিনে আনেন। প্রকৃত বিএমইটি কার্ড স্ক্যান করে তিনি নিজেই গ্রাফিক্সের কাজ করে কার্ড তৈরি করেন। এরপর ভিকটিমের পাসপোর্টে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী কার্ডের পেছনে তথ্য যুক্ত করা হয় ও বদরুলের নির্দেশমতো রিক্রুটিং লাইসেন্সের নম্বর বসিয়ে দিতেন। তিনি চার বছর ধরে ভিজিটিং কার্ড, আইডি কার্ডের ডিজাইন ও প্রিন্টের ব্যবসা করে আসছেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকে কাস্টমারদের চাহিদা অনুযায়ী অর্থের বিনিময়ে সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নকল কার্ড তৈরি করে সরবরাহ করতেন। মানবপাচারকারী চক্র ও বিএমইটি কার্ড জালিয়াত চক্রের ফাঁদে পড়ে ভিকটিমদের বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন ধুলিসাৎ হয়ে যায়।’
টিটি/এএএইচ/জেআইএম