টাকা দিয়েও সোলার প্যানেল পাচ্ছেন না চরের বাসিন্দারা
অডিও শুনুন
যেসব দুর্গম এলাকায় বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি সেসব জায়গায় সোলার প্যানেল স্থাপনের মাধ্যমে আলো পৌঁছে দিতে একটি প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। দেশের বিদ্যুৎবিহীন প্রত্যন্ত এলাকা এবং চরাঞ্চলে সৌরশক্তির উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্পের মাধ্যমে ছয় হাজার ৩৩৫টি পরিবারে সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন করার কথা।
তবে অভিযোগ উঠেছে, মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগে অসমাপ্ত রেখেই প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। প্রকল্প এলাকার লোকজনের দাবি, বাস্তবায়নকারী সংস্থা পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশন (পিডিবিএফ) কোনো ধরনের নোটিশ ছাড়াই প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। যে কারণে এক বছর আগে সরকারি কোষাগারে টাকা জমা দিয়েও সোলার প্যানেল পাচ্ছেন না তিস্তা পাড়ের শ্রমজীবী মানুষ। পিডিবিএফের দাবি, সোলার প্যানেল দেওয়ার সময় খুঁজেও গ্রাহক পায়নি তারা।
রংপুর সদর ও গঙ্গাচড়া উপজেলার তিস্তা পাড়ের মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ প্রকল্পের সুবিধা পেতে গত বছর ধারদেনা করে সোনালী ব্যাংকে ৪ হাজার ৯৩০ টাকা করে জমা দেন এ অঞ্চলের অনেকে। সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় তিন মাসের মধ্যে সোলার প্যানেল স্থাপনের কথা থাকলেও অনেকে তা পাননি এক বছরেও।
রংপুর সদরের হালিয়াখালী ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ডে শত শত গ্রাহক টাকা দিয়েও সৌরবিদ্যুৎ পাননি বলে অভিযোগ করেছেন। টাকা জমা দেওয়ার পরও সোলার প্যানেল না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ তারা। তবে ওই এলাকার মানুষেরা এখনো জানেনই না যে প্রকল্প গুটিয়ে নেওয়া হয়েছে। তারা এখনো সোলার প্যানেল পাওয়ার আশায় রয়েছেন। তিস্তা পাড়ের প্রত্যন্ত চরের এসব বাসিন্দা এখনো মনে করেন, তাদের ঘরে জ্বলে উঠবে সৌরবিদ্যুতের আলো।
রংপুরের চর অধ্যুষিত উপজেলা গঙ্গাচড়ার কোলকোন্দ, বড়বিল, ঘজঘণ্টা, বেতগাড়ী, লক্ষীটারি, নোহালী, মর্ণেয়া, আলমবিদিতা ইউনিয়নের প্রায় দেড় হাজার গ্রাহক টাকা দিয়েও সোলার প্যানেল পাননি। ওই অঞ্চলের অনেক বাসিন্দাই এ অভিযোগ করেছেন।
নোহালী ইউনিয়নের বাসিন্দা রাকিবুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, চরাঞ্চলে বিদ্যুৎ নেই। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ায় খুব সমস্যা হচ্ছে। এজন্য ধারদেনা করে সৌরবিদ্যুতের সোলার সিস্টেম স্থাপনের জন্য প্রায় পাঁচ হাজার টাকা জমা দেই। সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে পিডিবিএফের হিসাবে এ টাকা জমা দিয়েছি। তিন মাসের মধ্যে সোলার প্যানেল স্থাপনের কথা থাকলেও বছর শেষ হয়ে গেছে। আদৌ সোলার প্যানেল পাবো কি না জানি না। সৌরবিদ্যুৎ থাকলে অন্তত অন্ধকারটা একটু ঘোচানো যেত। বাচ্চারাও ঠিকমতো পড়াশোনা করতে পারতো।
নোহালী ইউনিয়ন পরিষদের ১ নং ওয়ার্ডের সদস্য (মেম্বার) ফজলু বলেন, আমরা সোলার সিস্টেমের জন্য টাকা জমা দিয়েছি এক বছরের বেশি হয়েছে। আমাদের ওয়ার্ডের অনেকে ধারদেনা করে টাকা দিয়েছেন। কিন্তু এখন পিডিবিএফ বলছে আমাদের সোলার দেবে না। অফিসে গেলে আমাদের বলা হচ্ছে জমা দেওয়া টাকা তুলে নিতে। কিন্তু আমরা তো ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য এক বছর ধরে টাকা ফেলে রাখিনি। আমরা টাকা ফেরত চাই না, সোলার চাই।
চরাঞ্চলে সৌরশক্তির উন্নয়ন প্রকল্পের বিষয়ে কথা হয় গঙ্গাচড়া উপজেলার কোলকোন্দ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সোহরাব হোসেন রাজুর সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী চান চরাঞ্চলের মানুষ আলোকিত হোক। অর্থ জমা নিয়ে যারা এতদিন ধরে সোলার প্যানেল দিচ্ছে না, তদন্তসাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। যত শিগগির সম্ভব এ প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে এলাকার উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা উচিত।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশের বিদ্যুৎবিহীন প্রত্যন্ত এলাকা এবং চর এলাকায় সৌরশক্তির উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্পের মাধ্যমে চরাঞ্চলে ছয় হাজার ৩৩৫টি সোলার প্যানেল স্থাপনের কথা। এ প্রকল্পে ১৫ কোটি ৬১ লাখ ৫৭ হাজার টাকা ব্যয়ে কাজ পায় ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং। কাজের অগ্রগতির জন্য ডকইয়ার্ড থেকে দুটি কোম্পানিকে কাজ সম্পন্ন করার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পিডিবিএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহম্মদ মউদুদউর রশীদ সফদার জাগো নিউজকে বলেন, আমরা ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংকে এ প্রকল্পের কাজ দেই। তারা আউট সোরর্সিংয়ের মাধ্যমে দুটি কোম্পানি দিয়ে কাজ করিয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় যারা তালিকাভুক্ত হয়ে টাকা জমা দিয়েছিলেন তাদের আমরা সোলার প্যানেল দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। প্রকল্প মেয়াদের মধ্যে টাকা জমা দিয়ে সোলার প্যানেল পাওয়া যায়নি, এমন অভিযোগ আমাদের কাছে আসেনি।
তিনি বলেন, প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে টাকা জমা দেওয়ার পরও যদি কেউ সোলার প্যানেল না পেয়ে থাকেন, তাহলে আমাদের কাছে অভিযোগ করতে পারেন। অভিযোগ পেলে আমরা তদন্ত করে দেখবো। যদি সবকিছু ঠিক থাকে তাহলে তাদের বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
চরের মানুষদের সোলার প্যানেল দেওয়ার ক্ষেত্রে কাজ করা কোম্পানির কোনো গাফিলতি আছে কি না— এমন প্রশ্ন করা হলে পিডিবিএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, তাদের গাফিলতি আছে এ কথা বলবো না। বরং আমরা সোলার প্যানেল দেওয়ার সময় খুঁজেও মানুষ পাইনি। যদি কেউ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর টাকা জমা দেন, তাদের সোলার দেওয়া সম্ভব নয়।
ডকইয়ার্ড থেকে যে দুটি কোম্পানিকে কাজ দেওয়া হয় তার একটি সোলার ইলেক্ট্রো বাংলাদেশ লিমিটেড (এসইবিএল)। যোগাযোগ করা হলে এই কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ডি এম মজিবর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, চরের মানুষেরা সোলার প্যানেল যদি না পান, এক্ষেত্রে আমাদের কোনো গাফিলতি নেই। আমরা সোলার প্যানেল দেওয়ার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগেই কোনো ধরনের নোটিশ ছাড়াই কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বারবার পিডিবিএফের দ্বারস্থ হলেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। আমাদের সরবরাহ করা সোলার প্যানেলসহ যন্ত্রপাতি প্রকল্প এলাকায় নষ্ট হচ্ছে। এতে আমরা আর্থিক ক্ষতির মধ্যে পড়েছি।
এমএএস/কেএসআর/এইচএ/জেআইএম