স্থানীয় নির্বাচনের সূত্রে আশা-নিরাশা
পৌর নির্বাচন নিয়ে শীতের মৌসুমটা সরগরম রয়েছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেক দিন ধরেই সরকার একাই তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছিল। আর হয়ত ইসলামের নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যস্ত আছে কোনো কোনো গোপন বা নিষিদ্ধ সংগঠন।
এদিক থেকে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন দেশের মফঃস্বল ও গ্রামীণ জনপদে বেশ প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। বলা হয়ে থাকে বাঙালি ভোটের নামে পাগল। ভোটের হুজুগে মেতে উঠতে তার জুড়ি নেই। অতি উৎসাহী প্রার্থী আর ভোটারদের বাড়াবাড়িতে প্রায়ই নির্বাচনী বিধিমালা ভঙ্গের অভিযোগ উঠছে। প্রার্থী, ভোটার এবং জনসাধারণের উৎসাহের মূল্য আছে, বিশেষত বর্তমান পরিস্থিতিতে। তাই হয়ত বিভিন্ন পক্ষের অভিযোগ-আপত্তিগুলো পরিস্থিতির তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারছে না। উৎসাহ এবং নিয়ম ভঙ্গ একইভাবে একই গতিতেই চলছে।
সবার জন্যে স্বস্তির বিষয় হল দেশের অপর বড় দল বিএনপি এ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। কিছু ভয়ভীতির কথা শোনা গেলেও মোটের ওপর তারা নির্বাচনী প্রচারাভিযানে ভালোভাবেই আছে। ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলেছেন, নির্বাচন বর্জনের কোনো সম্ভাবনা নেই। আর চেয়ারপার্সনের একাধিক উপদেষ্টা মনে করেন ভোটের দিন ফল গণনা পর্যন্ত কর্মীদের সতর্ক থেকে সক্রিয় থাকতে হবে।
গণতন্ত্রের প্রাণবায়ু হল নির্বাচন। আর স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে গণতান্ত্রিক প্রাণবন্ততা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে যায়। দেশের জনগণ প্রাণ ফিরে পাচ্ছে এটা অবশ্যই শুভ খবর।
এ নির্বাচনে বড় দুই দলের জন্যে একটা উইন-উইন পরিস্থতি তৈরি হয়েছে বলে মনে হয়। আওয়ামী লীগের অন্যতম রাজনৈতিক এজেন্ডা ছিল বিএনপিকে জামায়াত থেকে বিচ্ছিন্ন করা, তাদের আত্মবিশ্বাসে একটু চিড় ধরিয়ে দেওয়া, সেই সাথে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করা অর্থাৎ নির্বাচনমুখী করা। এ উদ্দেশ্য অনেকাংশে সফল হয়েছে।
বিএনপি গত দু’বছর ধরে সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছে, সরকারের প্রবল পুলিশি চাপের মুখে সাংগঠনিক স্থবিরতায় ভুগছে, নেতা-কর্মীরা অনেক হাতড়েও পথের সন্ধান না পেয়ে হতাশায় ভুগছিল। এ অবস্থায় পৌর নির্বাচন তাদের নেতা-কর্মীদের জন্যে পথের সন্ধান হয়ে এসেছে। বহুদিন পরে তারা নির্বাচনী প্রার্থী নিয়ে জনগণের সামনে আসতে পেরেছে, প্রচারণার সাথে সাথে নিজেদের দলীয় রাজনৈতিক বক্তব্যও তুলে ধরতে পারছে।
এখন প্রচারণা পুরোদমে চলছে এবং অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে অনেক কেন্দ্রেই হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতে পারে। আমরা জানি বাংলাদেশের মানুষের একটা অংশের মধ্যে ইসলামপন্থী রাজনীতির প্রতি দুর্বলতা আছে। যদিও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আন্তরিকভাবেই ধর্মচর্চা করেন তবুও কিছু মানুষ ইসলামপ্রীতি, ভারত বিদ্বেষ, সংখ্যালঘু বৈরিতা- এই তিন সূত্রে আওয়ামী লীগের প্রতি সংশয় পোষণ করে থাকেন। ফলে নির্বাচন বেশ খোলামেলা সম্ভাবনার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে উভয় দলের জন্যে। এ নির্বাচনে বিএনপির লাভ এই যে জনগণের ধারণা হবে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার সমান সুযোগ তাদেরও আছে। এখানেই আবার সরকারি দল আওয়ামী লীগের জন্যে বিব্রতকর বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। যদি তাদের অধিকাংশ প্রার্থী বিজয়ী হয় তাহলে বিরোধী দল প্রশ্ন তুলবে নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিয়ে, নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে। এ প্রশ্ন হালে পানি পাওয়ার বাস্তব কারণ রয়েছে সাম্প্রতিক অতীতের স্থানীয় সরকার নির্বাচনের অভিজ্ঞতার কারণে। আর নির্বাচনে যদি আওয়ামী লীগের কম প্রার্থী জয়ী হয় তবে অবশ্যই প্রশ্ন উঠবে সরকারের জনপ্রিয়তা নিয়ে। এবং তারই লেজুড় হয়ে সমালোচনা হবে যে, সরকার পরাজয়ের ভয়ে সকল পক্ষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে অনিচ্ছুক। এ কথার মধ্যেও সত্যতা খোঁজার লোকের অভাব হবে না।
কিন্তু গত দু’ বছরে প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা তাঁর রাষ্ট্রনায়কেচিত ভূমিকা ও নেতৃত্বকে অন্য এক স্তরে উন্নীত করতে পেরেছেন। তিনি এখন ঠিক দলীয় সভানেত্রী নন, তিনি বরং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশের ও জনগণের নেত্রীর ভূমিকা নিতে পেরেছেন।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যেমন তাঁর সাফল্য তেমনি এটিই বিএনপির জন্যে চরম নেতিবাচক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এছাড়াও ক্ষমতায় এসে তিনি আরও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ প্রায় ঘোষণা দিয়েই মাথায় তুলে নিয়েছিলেন। তার মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ, বিদুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, শিক্ষার উন্নয়নে তাঁর নেতৃত্বের সাফল্য চোখে পড়ার মত। বিশ্ব ব্যাংকের সাথে টক্কর দিয়ে দেশীয় অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ শুরু করে দেওয়ার বিপরীতে বিশ্বব্যাংকের আনীত অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থতা তাঁকে বাড়তি আত্মবিশ্বাস জোগাচ্ছে, তাঁর ভাবমূর্তি গৌরবান্বিত করছে। দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা হয়েছে, মুদ্রাস্ফীতি আয়ত্বে আছে, দ্রব্যমূল্য প্রায় স্থিতিশীল, বাজারে সরবরাহ পরস্থিতি ভালো, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দু’দুটো অর্থনৈতিক মন্দা সত্ত্বেও প্রবৃদ্ধির হার ছয়ের ওপরে থাকাও তাঁর নেতৃত্বে জয়গানই গায়।
শেখ হাসিনা খালেদা জিয়ার মত আত্মকেন্দ্রিক আবার পরনির্ভরশীল নেতা নন। একইভাবে উত্তরাধিকারের রাজনীতি দিয়ে যাত্রা শুরু করলেও তিনি তা থেকে বেরিয়ে নিজের স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব ও ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। বরং সমালোচনা আছে যে তিনি নিজেই অনেক বেশি কথা বলছেন, অনেক বেশি কাজ করেছেন। তবে ক্রান্তিকালের এ সময়ে আত্মবিশ্বাসী বলিষ্ঠ নেতৃত্বই বাংলাদেশে দরকার- সেটা সম্ভবত মানুষ ধীরে ধীরে বুঝতে পারছে।
সাধারণের বিচারে উন্নয়নের পথে দুর্নীতি এবং সন্ত্রাসই সবচেয়ে বড় বাধা এবং সরকারের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ। এটাও স্পষ্ট যে অঙ্গসংগঠন ও দলের বিভিন্ন স্তরে রীতিমত লুটপাটে তৎপর রয়েছে অনেক নেতাকর্মী। দলটি এককভাবে সকল ক্ষমতা এবং সকল পরিসর দখলে রাখলে অন্যান্য দল থেকে নানা মতলবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অবশ্য কুমতলবে অনেকেই দলে ঢুকে পড়বে। বলা বাহুল্য জামায়াত ও ধর্মান্ধ শক্তির নেতা-কর্মীরাও যোগদানের মিছিলে শরিক হবে তাতে সন্দেহ নেই।
এ নির্বাচন শেষ পর্যন্ত আমাদের রাজনীতির গ্রন্থিমোচন করতে পারবে কিনা বলা মুশকিল। কারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে সাময়িক কৌশল হিসেবে বিএনপি জামায়াতকে ছেড়েছে কিনা বা জামায়াত বিএনপির কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখছে কিনা তা বোঝা যাবে নির্বাচনের পরে। গণতন্ত্রের প্রাথমিক শর্ত তো সকল নাগরিকের সমানাধিকার, রাষ্ট্রের মূল নীতির ব্যাপারে রাজনৈতিক ঐকমত্য। এ দুটি আদর্শিক ক্ষেত্রে বড় দুদলে দূরত্ব আদতেই কিছু ঘুচল কিনা তা আমরা জানি না। নির্বাচন রাজনৈতিক অঙ্গনে যে সুবাতাস এনেছে তা সাময়িক না স্থায়ী হবে তা নির্ভর করছে বড় দুই দলের ওপর। বিএনপির ওপর বিশেষভাবে।
লেখক : কবি, চিন্তাবিদ, সাংবাদিক
এইচআর/এমএস