নাটোরে আ.লীগ প্রার্থীদের আচরণবিধি লঙ্ঘনের হিড়িক
পৌর নির্বাচনকে ঘিরে নাটোরে সরকার দলীয় সংসদ সদস্য এবং মেয়র প্রার্থীদের আচরণবিধি লঙ্ঘনের হিড়িক পড়েছে। মেয়র প্রার্থীদের জরিমানা করেও ঠেকানো যাচ্ছে না আচরণবিধি লঙ্ঘন। গত দুই দিনে আওয়ামী লীগ মনোনীত দুই মেয়র প্রার্থীকে ৬০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত।
অভিযোগ রয়েছে, পৌরসভার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের নামে সরকার দলীয় সংসদ সদস্যরা নিজেদের প্রার্থীর পক্ষে ভোট চেয়ে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করছেন। তবে সংশ্লিষ্ট রিটানিং কর্মকর্তা বলছে, সুষ্ঠু নির্বাচন করতে তারা বদ্ধ পরিকর।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, নাটোরের বড়াইগ্রাম পৌরসভার মেয়র প্রার্থীদের জন্য একটি করে নির্বাচনী অফিস খোলার নিয়ম রয়েছে। তবে সেখানকার আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী আব্দুল বারেক তার নির্বাচনী এলাকায় ১৪টি অফিস খোলেন। এ নিয়ে বিএনপি মনোনীত মেয়র প্রার্থী ইসাহাক আলী রিটানিং কর্মকর্তা বরাবার অভিযোগ করলে গত বৃহস্পতিবার (১৭ ডিসেম্বর) সকালে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে মেয়র প্রার্থী আব্দুল বারেক সরদারকে ১০হাজার টাকা জরিমানা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত।
ঠিক একদিন পর ১৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় বড়াইগ্রাম পৌরসভার আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী আব্দুল বারেকের পক্ষে লক্ষ্মীকোল বাজার থেকে একটি মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা বের করে। শোভাযাত্রাটি পৌর এলাকার মৌখড়া বাজারে গিয়ে শেষ। এ সময় খবর পেয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নাসরিন বানু সেখানে পৌঁছে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে আচরণবিধি লঙ্ঘন করায় ১১(২) ধারায় মেয়র প্রার্থী আব্দুল বারেককে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। বারেকের পক্ষে তার ভাই বাখের সরদার জরিমানার টাকা পরিশোধ করেন।
এ বিষয়ে বড়াইগ্রামের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নাসরিন বানু বলেন, নির্বাচন স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ করতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের আইনি পদক্ষে নেয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে কোনো প্রার্থীকেই বিশেষ সুবিধা দেয়া হবে না। তিনি বলেন, আচরলণবিধি লঙ্ঘন করায় আওয়ামী লীগ মনোননীত প্রার্থীর দুই দফায় জরিমানা করা হয়েছে।
অপরদিকে, একই দিন লালপুর উপজেলার গোপালপুর পৌরসভায় নাটোর-৪ আসনের সংসদ সদস্য অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস আকষ্মিকভাবে গোপালপুর রেলগেট এলাকায় যায়। এ সময় সংসদ সদস্যের সঙ্গে গোপালপুর পৌরসভার আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী রোকসানা মোর্ত্তজা লিলি উপস্থিত হয়ে নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয়ে মত বিনিময় করেন। এ ঘটনায় রোকসানা মোর্ত্তজা লিলিকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শফিকুর আলম।
এ বিষয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শফিকুর আলম বলেন, তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে এমপি আব্দুল কুদ্দুসকে পাননি। তবে শুনেছি কিছুক্ষণ আগেই তিনি স্থান ত্যাগ করেছেন। তবে অনেক লোকের জমায়েত দেখে রোকসানা মোর্ত্তজা লিলির ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
এছাড়া গত ১৭ ডিসেম্বর নাটোরের বড়াইগ্রাম পৌর এলাকার বড়াইগ্রাম অনার্স কলেজের নবনির্মিত দ্বিতল ভবন, শহীদ মিনার ও মুক্ত মঞ্চের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন সংসদ সদস্য অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস। এ সময় আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী সেখানে গিয়ে ভোট প্রার্থনা করেন। তবে অভিযোগ রয়েছে, ওই অনুষ্ঠানে এমপি কুদ্দুস দলীয় মনোনীত প্রার্থীকে ভোট দেয়ার জন্য আহ্বান জানান।
এ বিষয়ে পৌরগ্রাম পৌরসভার বিএনপি মনোনীত মেয়র প্রার্থী ইসাহাক আলী অভিযোগ করে বলেন, সরকার দলীয় লোকজন তার পোস্টার ছেঁড়ার পাশাপাশি নেতা-কর্মীদের বিভিন্নভাবে হুমকি-ধামকি দিচ্ছে। তাছাড়া সরকার দলীয় এমপি অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস পৌরসভার বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের নামে নিজ দলের প্রার্থীর নামে বিভিন্ন স্থানে ভোট প্রার্থনা করছেন। যা নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের শামিল।
তবে সংসদ সদস্য অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস আচরণবিধি লঙ্ঘনের কথা অস্বীকার করে বলেন, বিগত নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীদের পোস্টার ছিঁড়ে ফেলে। কিন্তু বিএনপির যে আচরণ করে আওয়ামী লীগ তা করে না। আওয়ামীলীগ সমর্থিত প্রার্থীর গণজোয়ার দেখে বিএনপির প্রার্থী এখন ভুলভাল বকছেন।
এমপি কুদ্দুস আরও বলেন, পরিকল্পনা মন্ত্রী বলেছেন পৌরসভার উন্নয়ন আর নির্বাচন এক সঙ্গে হবে। সে দিক থেকে আমি পৌরসভার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড উদ্বোধন করেছি। তবে আমি যদি আচরণবিধি লঙ্ঘন করে থাকি নির্বাচন কমিশন আমাকে নোটিশ দিলে আমি তার উপযুক্ত জবাব দিবো।
এখানেই শেষ নয় গত ১৭ ডিসেম্বর (বৃহস্পতিবার) রাতে গোপালপুর পৌরসভার আওয়ামী লীগ দলীয় মেয়র প্রার্থী রোকসানা মোর্ত্তজা লিলির বাসায় ৪০মিনিট ধরে রুদ্ধদার সভা করেছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। তবে মেয়র প্রার্থী রোকসানা মোর্ত্তজা লিলির দাবি তিনি শুধু টয়লেট ব্যবহার করার জন্য তার বাসায় গিয়েছিলেন। অপরদিকে ১৮ ডিসেম্বর (শুক্রবার) সিংড়া পৌরসভা এলাকায় একাধিক উন্নয়ন কাজের উদ্বোধন করেছেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহম্মেদ পলক।
প্রত্যক্ষদর্শী ও কয়েকজন এলাকাবাসী জানান, প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহম্মেদ পলক শুক্রবার সকাল ৮টার দিকে পৌরসভার এক নং ওয়ার্ডে মন্তাজুর রহমানের ধানের চাতালে ও ১০টার দিকে দুই নং ওয়ার্ডে রজবের ধানের চাতালে নেতাকর্মীদের সঙ্গে কর্মী সমাবেশে মতবিনিময় করেন ও খিচুড়ি খাওয়ায় অংশ নেন। পরে প্রতিমন্ত্রী নিঙ্গইন ভাটোপাড়া জামে মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। বিকেলে তিনি পৌরসভায় মহেশচন্দ্রপুরেও অনুরূপ সমাবেশে যোগ দেন।
অপরদিকে, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সরকারি গাড়ি ও প্রটোকল নিয়ে বৃহস্পতিবার রাত ৮ টায় গোপালপুর পৌরসভার আওয়ামী লীগ দলীয় মেয়র প্রার্থী রোকসানা মোর্ত্তজা লিলির কেশবপুর গ্রামের বাসায় ঢোকেন। তিনি ঢোকার পর পরই ওই বাসা থেকে কর্মী সমর্থকদের বের করে প্রধান ফটক আটকে দেয়া হয়। এ সময় তার সঙ্গে ব্যক্তিগত লোকজন ছাড়া স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ছিলেন না। প্রটেকশনের দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা বাসার বাইরের ফটকের সামনে অবস্থান করছিলেন। এক পর্যায়ে ফটকের সামনের বৈদ্যুতিক বাতি নিভে যায়। ৪০ মিনিট অবস্থান করার পর ৮টা ৪০ মিনিটে তিনি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন।
ওই বাড়ির আশপাশের একাধিক প্রতিবেশি জানান, তারাও প্রতিমন্ত্রী আসার মুহূর্তে বাসার ভেতরে ছিলেন। তারা প্রার্থী রোকসানা মোর্ত্তজা লিলি ও তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করছিলেন। পরিবারের সদস্যদের অনুরোধে তারা বাড়ি থেকে বের হয়ে আসেন। তবে পরিবারের সদস্যসহ উপজেলা আওয়ামী লীগের একজন স্থানীয় নেতা বাড়িতে অবস্থান করেছেন।
নাটোর-১ (লালপুর-বাগাতিপাড়া) আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আবুল কালাম আজাদ মোবাইল ফোনে এই প্রতিবেদককে জানান, প্রতিমন্ত্রীর মেয়র প্রার্থীর বাসায় যাওয়ার কথা তিনি লোকমুখে শুনেছেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পৌনে ৭টা পর্যন্ত প্রতিমন্ত্রী লালপুরে উপজেলা আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে নেতা-কর্মীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। পরে তিনি সবার কাছে বিদায় নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যান। প্রার্থীর বাসায় কি নিয়ে আলাপ হয়েছে তা তিনি জানেন না বলে জানান।
গোপালপুর পৌরসভার রিটার্নিং কর্মকর্তা ও লালপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নজরুল ইসলাম ও লালপুর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল হাই তালুকদার বলেছেন, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম কি কারণে এসেছিলেন তা তাদের জানা নেই।
মেয়র প্রার্থী রোকসানা মোর্ত্তজা লিলি বলেন, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী টয়লেট ব্যবহারের জন্য আকষ্মিকভাবে তার বাসায় এসেছিলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি ঢাকার উদ্দেশ্যে চলে যান। তার বাসায় নির্বাচন সংক্রান্ত কোনো সভা হয়নি। প্রতিমন্ত্রী তার বাসায় অবস্থান করার সময় তিনি ও তার স্বামী নির্বাচনী কাজে বাইরে ছিলেন। তাদের সঙ্গে রাস্তায় দেখা হয়েছিল।
এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সঙ্গে কথা বলার জন্য বৃহস্পতিবার রাতেই মোবাইলে ফোন করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এছাড়া নাটোরের সিংড়ায় নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গের দায়ে বিএনপির অঙ্গ সংগঠন পৌর ওলামা দলের সভাপতি আতিকুর রহমানকে দুই মাসের কারাদণ্ড দিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। শনিবার গভীর রাতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সহকারী কমিশনার (ভূমি) জাহিদুল ইসলাম এ আদেশ দেন।
পুলিশ জানায়, গত রাত ১টার দিকে পৌর ওলামা দলের সভাপতি আতিকুর রহমান সিংড়া পৌর এলাকার ৫ নং ওয়ার্ডে টাকা দিয়ে ভোট কিনতে যায়। এ সময় স্থানীয়রা তাকে হাতে নাতে ধরে পুলিশে খবর দেয়। এ সময় তার কাছ থেকে ৩৩০০ টাকা ও একটি ছুড়ি (চাকু) জব্দ করা হয়। পরে গভীর রাতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সহকারী কমিশনার ভূমি জাহিদুল ইসলাম তাকে দুই মাসের কারাদণ্ডের আদেশ দেন।
এ বিষয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জাহিদুল ইসলাম বলেন, নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গের দায়ে আতিকুর রহমানকে এ সাজা প্রদান করা হয়েছে।
রেজাউল করিম রেজা/এসএস/পিআর