এহন আমগর জমি তিন ফসলি অইছে
শেরপুরের নকলা উপজেলার উত্তরাংশে সরিষা আবাদ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভ্রাম্যমাণ মৌ-চাষিদের বাড়তি আয়ের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এখানকার বিস্তৃত এলাকায় সরিষা চাষের উপর ভিত্তি করে এক ভ্রাম্যমাণ মৌ-চাষি মধু আহরণ করে বাণিজ্যিকভাবে বাজারজাত করে আসছেন।
সরিষা ক্ষেতের পাশে এই ভ্রাম্যমাণ মৌ-চাষ স্থানীয় সরিষা চাষিদের মধ্যে বাড়তি আয়ের সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে।
কৃষকরা জানান, আমন কাটার পর তাদের জমি পতিত থাকতো। এখন আমন এবং বোরোর মাঝে তারা মাত্র ৮০ দিনের বারি-১৪ জাতের সরিষা ঘরে তোলার পরও বোরোর চাষ করতে পারছেন। এজন্য কৃষকরা বেশ খুশি। তারা বলছেন, স্বল্প সময়ে সরিষা উঠে যায়। সরিষা বিক্রির টাকায় তারা বোরোর খরচ তুলতে পারেন। তাছাড়া সরিষা করার পর বোরোতে সারও কম লাগে। এখন সরিষা ক্ষেতের পাশে মৌ-চাষ করে আরও বাড়তি আয়ের বিষয়টি তাদেরকে আরও উৎসাহিত করেছে।
কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, সরিষা আবাদের সময় মৌ-চাষ করায় মৌমাছির মাধ্যমে পরাগায়নের ফলে সরিষার দানা পুষ্ট হয়। এতে ফলন বেশ ভালো হয়। সরিষা ক্ষেতের আইলে মৌ-চাষ বিষয়ে কৃষকদের প্রশিক্ষণ এবং সহায়তা দেওয়া গেলে স্থানীয় কৃষি অর্থনীতিতে এটা নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে।
শেরপুর খামারবাড়ির হিসেব মতে, চলতি মৌসুমে শেরপুর জেলায় এবার সাড়ে সাত হাজার হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। কৃষকদের আগ্রহের কারণে জেলায় সরিষার আবাদ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। নকলা এবং নালিতাবাড়ী উপজেলায় নতুন নতুন এলাকা সরিষা চাষের আওতায় আসছে।
ভ্রাম্যমাণ মৌ-চাষি ফজলুর রহমান জাগো নিউজকে জানান, প্রায় ১০ বছর আগে বিসিক থেকে মাত্র কয়েকদিনের প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি এ মৌ-চাষ শুরু করেছিলেন। মাত্র ৩/৪ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেই ভালো আয় করা সম্ভব বলে তিনি উল্লেখ করেন।
নকলার বানেশ্বর্দী এলাকার বাসিন্দা এই মৌ চাষি জাগো নিউজকে জানান, শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি ভ্রাম্যমাণ মৌচাষ করে মাসে গড়ে ১৫/১৬ হাজার টাকা আয় করছেন। তাছাড়া এর মাধ্যমে চারজন বেকার যুবকের কর্মসংস্থানও হয়েছে। এবার ধামনা এলাকায় ৫৬টি মৌ-বাক্স স্থাপন করে গড়ে প্রতি বাক্স থেকে সপ্তাহে দুইবার প্রায় ২/৩ কেজি করে মধু আহরণ করা হচ্ছে। প্রতি কেজি মধু বিক্রি হয় গড়ে ২শ` টাকা থেকে ৫শ` টাকায়। ভ্রাম্যমাণ মৌ-চাষ করে এলাকার কৃষকদের বাড়তি আয়ের পাশাপাশি বেকারদেরও কর্মসংস্থান করা সম্ভব বলে তিনি জানান।
ধামনা গ্রামের কৃষক মো. রমজান আলী (৬২) জাগো নিউজকে বলেন, আগে আমাদের এলাকায় দুই ফসল অইতো। আমুন ধান করার পরে জমি পতিত থাকতো। পরে বোরো ধান লাগাইতাম। কিন্তু এহন আমগর জমি তিন ফসলী অইছে। আমুন কাটার পরে ওই জমিতে সরিষা করি। মাত্র ৮০ দিনেই সরিষা কাইট্টা ওই জমিনে আবার বোরো ধান করি। আর সরিষা কইরা এহন আমাদের কিছু বাড়তি টাকা আয় হয়।
তিনি জানান, এক একর জমিতে সরিষা আবাদে মাত্র সাত হাজার টাকা খরচ হয়। আর তাতে যে সরিষা পাওয়া যায় তা বিক্রি করে ২৪ হাজার টাকা আয় হয়। এটাতে দারুণ লাভ। তাছাড়া সরিষায় যে সার দেয়া হয়, তাতে বোরোতে সারও কম লাগে ফলনও ভালো হয়।
আরেক কৃষক আবু তাইয়িব মিয়া (৪২) জাগো নিউজকে বলেন, কয়েক বছর ধইরা আমাদের এলাকায় সরিষার আবাদ বাড়ছে। এখন আবার সরিষার সঙ্গে বাক্সে মৌমাছি চাষ করে মধু সংগ্রহ করার বিষয়টি আমাদেরকে নতুন আয়ের চোখ দেখিয়েছে। আমরা এখন চিন্তা-ভাবনা করছি, কিভাবে বাক্সে মৌমাছি পালন করা যায়। এইরহম কিছু ট্রেনিং পাইলে ভালো হতো।
নকলা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবীর জাগো নিউজকে জানান, সরিষা একটি ক্রস পলিনেটেড ফসল। মৌমাছির মাধ্যমে পরাগায়নের ফলে সরিষার ফলন শতকরা ১৫ থেকে ২০ ভাগ বৃদ্ধি পায়। এবার নকলা উপজেলায় এক হাজার ১শ` হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। তন্মধ্যে উরফা এবং নকলা সদর ইউনিয়নেই চাষ হয়েছে ৪৫০ হেক্টর। সরিষার সঙ্গে মৌ-চাষ একটি লাভজনক বিষয়। ভ্রাম্যমাণ মৌ-চাষকে জনপ্রিয় করা গেলে সরিষার সঙ্গে মৌমাছি পালন ও মধু সংগ্রহ করে প্রতিমাসে বাড়তি প্রায় ৬/৭ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব।
প্রতি সপ্তাহে প্রতিটি মৌ-বাক্স থেকে আড়াই থেকে তিন কেজি করে মধু আহরণ করা যায়। এজন্য সরিষা চাষিদের মৌ-চাষে উদ্বুদ্ধকরণ ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে এ মৌসুমে ১০ জন সরিষা চাষিকে বিসিকের সহযোগিতায় ভ্রাম্যমাণ মৌ-চাষ বিষয়ে প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে।
এমজেড/এমএস