চট্টগ্রাম নগরে ৩৬৬ প্রজাতির ঔষধি গাছ শনাক্ত: গবেষণা
চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন স্থানে ৩৬৬ প্রজাতির ঔষধি গাছের সন্ধান পেয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) একদল গবেষক। গবেষণায় নগরের ২০টি এলাকায় মোট ৪৯৫ প্রজাতির উদ্ভিদ শনাক্ত করা হয়। এর মধ্যে বড় বৃক্ষ ১৭৭, গুল্মজাতীয় ৮৬, বীরুৎজাতীয় ১৭৯ ও লতাজাতীয় ৫৩ প্রজাতির উদ্ভিদ পাওয়া গেছে। আবার শনাক্ত হওয়া উদ্ভিদের মধ্যে ৩৫৪ প্রজাতি দেশি ও ১৪১টি প্রজাতি বিদেশি বলে জানা গেছে। এছাড়াও নগরে বিপন্নপ্রায় ১৩ ও সংরক্ষণ না করলে ভবিষ্যতে বিলুপ্ত হতে পারে এমন প্রায় ১৩৭ প্রজাতির উদ্ভিদ শনাক্ত করা হয়েছে।
মঙ্গলবার (২৪ আগস্ট) গবেষকদলের প্রধান ও চবি উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক রাসেল জাগো নিউজকে এ তথ্য জানান।
তিনি জানান, এ বছরের মার্চ মাস থেকে বেসরকারি মানবিক ও সামাজিক উন্নয়ন সংস্থা ইফেক্টিভ ক্রিয়েশন অন হিউম্যান ওপিনিয়নের (ইকো) অর্থায়নে চট্টগ্রাম নগরের উদ্ভিদ নিয়ে একটি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল চট্টগ্রাম শহরের উদ্ভিদরাজির পুরো চিত্র তুলে আনা, অজানা প্রজাতিগুলো শনাক্ত করা ও বিপন্ন প্রজাতিগুলো চিহ্নিত করা। যাতে এগুলো সংরক্ষণে আগাম পরিকল্পনা নেওয়া যায়। এছাড়াও ওষুধি উদ্ভিদগুলো শনাক্ত করে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে পরিচিত করা।
গবেষকরা জানান, নগরে শনাক্ত হওয়া রোগভিত্তিক উল্লেখযোগ্য ঔষধি উদ্ভিদ হচ্ছে-
১. চর্মরোগের জন্য– চালমুগড়া (Hydnocarpus kurzii), মিঠা আলু (Ipomoea batatas), পাতি লতা ফার্ন (Lygodium microphyllum), ঝুমকো লতা (Passiflora foetida), জংলি বাদাম (Sterculia foetida), কাঠ বাদাম (Terminalia catappa), নিশিন্দা (Vitex negundo)।
২. আলসারের জন্য– বন আলু (Dioscorea bulbifera), গেজিয়া শাক (Elephantopus scaber), পাকুড় (Ficus benjamina), আমলকি (Phyllanthus emblica), গোল মরিচ (Piper nigrum)।
৩. ডায়াবেটিস রোগের জন্য– মদন মোস্তা (Actinodaphne angustifolia), বিদ্যা পাতা (Adiantum caudatum), দেশি ছোট এলাচ (Alpinia calcarata), নটি শাক (Amaranthus viridis), বন শিমুল (Bombax insigne), ছোট আকন্দ (Calotropis procera) ও বরুনা (Vitex peduncularis)।
৪. জন্ডিস রোগের জন্য– বন শিমুল (Bombax insigne), কুকুরচিতা (Litsea glutinosa), গোল মরিচ (Piper nigrum), ললনা (Premna esculenta) ও হরিনা (Vitex peduncularis)।
৫. যক্ষ্মার জন্য– মুক্তাঝুড়ি (Acalypha indica), ডাবেরক্রেপি (Crassocephalum crepidioides), ডাঘ্নো মদি (Desmodium dichotomum), কালো তুলসি (Ocimum tenuiflorum),গন্ধ বাডালী (Paederia foetida) ও ধারমারা (Stereospermum colais)।
৬. মানসিক রোগের জন্য– সাদা কাঞ্চন (Bauhinia acuminate), ভাটিয়া লতা (Cissus adnate), সোনাতল (Diploclisia glaucescens), চালমুগড়া (Hydnocarpus kurzii), কেড়োগেথিস (Lepidagathis incurve), লতা ঢেকি (Lygodium flexuosum), গন্ধলি (Ophiorrhiza mungos) ও ভেরেন্ডা (Ricinus communis)।
৭. বাত রোগের জন্য– ঝুনঝুনি (Crotalaria pallida), শিলাঝড়া (Elatostema papillosum), কুকুরচিতা (Litsea glutinosa), হরিনা (Vitex peduncularis), ছাতিম (Alstonia scholaris) ও বিষলতা (Hedyotis scandens)।
৮. আমাশয় রোগের জন্য– বাংলা বট (Ficus benghalensis), ঝজ্ঞা ডুমুর (Ficus racemose), কুরচি (Holarrhena antidysenterica), কুকুরচিতা (Litsea glutinosa), অশোক (Saraca asoca) ও রঙ্গন (Ixora coccinea)।
৯. হাঁপানি রোগের জন্য– ন্যাটা সাইকাস (Cycas pectinate), ঝজ্ঞা ডুমুর (Ficus racemose), কুকুরচিতা (Litsea glutinosa), বন পান (Piper sylvaticum) ও শিয়াল মুত্র (Vernonia patula)।
১০. উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে– উটল কম্বল (Abroma augusta), ধতুরা (Datura metel), মেস্তা (Hibiscus sabdariffa), সজনে (Moringa oleifera) ও বহেড়া (Terminalia bellirica)।
১১. ব্রঙ্কাইটিস রোগের জন্য– অগ্নি গাছ (Cymbopogon citratus), কেশরাজ (Eclipta prostrata), ঝজ্ঞা ডুমুর (Ficus racemose), কলমি শাক (Ipomoea aquatic), বন পান (Piper sylvaticum) ও দাদমর্দন (Senna alata)।
১২. পাইলস রোগের জন্য– দুর্বা ঘাস (Cynodon dactylon), শালপানি (Desmodium gangeticum), চুপড়ি আলু (Dioscorea alata), গামারি (Gmelina arborea) ও লাল ভেরেন্ডা (Jatropha gossypifolia)।
এদিকে, গবেষণায় শনাক্ত হওয়া বিপন্ন প্রজাতির উদ্ভিদগুলো হচ্ছে- হলদে বেত (Dypsis lutescens), নাটা সাইকাস (Cycas pactinata), শীতশাল (Dalbergia latifolia), গর্জন (Dipterocurpus alatus), লম্বু (Khaya anthotheca), শ্বেত চন্দন (Santalum album), অশোক (Saraca asoca), ঢাকিজাম (Syzygium firmum), দুধকুরুস (Wrightia arborea), বাকা গুলঞ্ছ (Tinospora erispa) ও সোনাতলা (Diploclasia glaucescens)।
আবার ভবিষ্যতে বিলুপ্ত হতে পারে এমন উদ্ভিদগুলো হচ্ছে- মেঞ্জিয়াম (Acacia mangium), হারগোজা (Acanthus ilicifolius ), টাইগার ফার্ন (Acrosticum aureum), কঞ্চি এলাচ (Alpinia conchigera), ছাতিম (Alstonia scholaris), বেত (Calamus tenuis), বড় ডুমুর (Ficus auriculata), যজ্ঞ ডুমুর (Ficus racemosa), কুরুজ (Holarrhena pubescens), কুকুরা (Leea indica), পিটালি (Mallotus nudiflorus), হরিতকি (Terminalia chebula), স্বর্পগন্ধা (Rauvolfia tetraphylla), বকুল (Mimusops elengi), শিমুল (Bombax ceiba), পিতরাজ (Aphanamixis polystachya) ও দুরন্ত (Duranta erecta)।
এ বিষয়ে ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক রাসেল জাগো নিউজকে বলেন, চট্টগ্রাম নগরে পাহাড়নিধন, পাহাড়ে অপরিকল্পিত বসবাস ও স্থাপনা নির্মাণ যদি বন্ধ করা না যায়, তবে ভবিষ্যতে গবেষণায় শনাক্ত হওয়া বিপন্নপ্রায় ১৩ প্রজাতি ও ওষুধি ৩৬৬ প্রজাতিসহ মোট ৪৯৫ প্রজাতির অনেক উদ্ভিদই হারিয়ে যাবে। যা চট্টগ্রাম শহরের স্বাভাবিক পরিবেশ বিনষ্ট করবে। তাই এখনই উদ্ভিদ সংরক্ষণে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া অত্যন্ত জরুরি।
ইকোর সভাপতি মো. সরওয়ার আলম চৌধুরি মনি, সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য শাহেদ মুরাদ সাকু ও এসএম আবু ইউসুফ সোহেলের সহযোগিতায় গবেষণাটির নেতৃত্বে আরও ছিলেন চবি উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সাবেক-বর্তমান একদল ছাত্র। তারা হলেন- মো. খন্দকার রাজিউর রহমান, ইমাম হোসেন, সজীব রুদ্র, মো. আরিফ হোসাইন, সনাতন চন্দ্র বর্মন, মো. মোস্তাকিম ও মো. ইকরামুল হাসান।
মিজানুর রহমান/এআরএ/জিকেএস