মুসলিম স্ত্রীকে হত্যার পর দাহ : দায় স্বীকার স্বামীর
মুসলিম ধর্মাবলম্বী স্ত্রীকে হত্যার পর আলামত নষ্ট করতে সনাতন ধর্মের রীতি অনুযায়ী মরদেহ দাহ করার দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন বাবলু দে ওরফে তনু (৩০)।
শনিবার (২১ আগস্ট) চট্টগ্রামের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বেগম আঞ্জুমান আরার আদালতে দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন তিনি।
বিষয়টি নিশ্চিত করে মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জিয়া হাবিব আহসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘স্ত্রী হত্যার দায় স্বীকার করে গ্রেফতার বাবলু আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দি শেষে আদালত তাকে কারাগারে প্রেরণের আদেশ দেন।’
পুলিশ ও আদালত সূত্রে জবানবন্দির বিষয়ে জানা গেছে, বাবলু চান তার স্ত্রীকে নিয়ে গ্রামে বসবাস করতে। বিপরীতে শহরে বসবাস করতে চান ইয়াছমিন আক্তার অ্যানি (২৪)। বিষয়টি নিয়ে দুজনের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলে আসছিল। সবশেষ গত ৩ আগস্ট তাদের মধ্যে ঝগড়া হয়। একপর্যায়ে ইয়াছমিনকে থাপ্পড় মারেন বাবলু। এতে ইয়াছমিন অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যান। এরপর বাবলু একজন গ্রাম্য চিকিৎসক ডেকে আনেন। চিকিৎসক নিশ্চিত করেন ইয়াছমিন মারা গেছেন। ঘটনাটি নিয়ে বাবলু তার কাছের বন্ধু সুমনদের সঙ্গে পরামর্শ করেন। পরবর্তীতে হত্যাকাণ্ডের আলামত নষ্টের কৌশল হিসেবে স্থানীয় চেয়ারম্যানসহ বেশ কয়েকজনকে অবহিত করে বাবলু তার স্ত্রীর মরদেহ দাহ করেন।
এদিকে নিহতের পরিবারের দাবি, ইয়াছমিন স্ট্রোক করে মারা গেছেন বলে ফোন দিয়ে তাদের জানান বাবলু। কিন্তু পরিবারের সদস্যরা আসার আগেই বাবলু ইয়াছমিনের মরদেহ দাহ করেন।
এ ঘটনায় নিহতের মা রোকসানা বেগম ১৬ আগস্ট চট্টগ্রাম আদালতে একটি ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের করেন। আদালত অভিযোগটি আমলে নিয়ে বোয়ালখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) নিয়মিত মামলা হিসেবে রুজু করতে আদেশ দেন।
আদালতের আদেশপ্রাপ্ত হয়ে বাবলু দে, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মোকারম ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি রতন চৌধুরীসহ মোট ১৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ।
মামলার অন্য আসামিরা হলেন- পবন দাশ (৫৫), সাধন মহাজন (৬০), নিমাই দে (৪৫), শংকর দত্ত (৩৩), অরবিন্দ মহাজন (৫০), অরুন দাশ (৫০), দিলীপ দেব (৪৫), প্রদীপ সূত্রধর (৪০), রাম প্রসাদ (৩৮), রনি দে (৩০), অরুপ মহাজন (৪২), সমর দাশ (৫৫), রবীন্দ্র ধর (৬০), নিপুন সেন (৬০) ও ইউসুফ ওরফে ড্রেজার ইউসুফ (৩৫)। এদের মধ্যে পুলিশ শুক্রবার বিকেলে প্রধান আসামি বাবলুকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। পরদিন শনিবার বাবলুকে আদালতে হাজির করা হলে তিনি হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার জবানবন্দি দেন।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, বাবলু বোয়ালখালীর শ্রীপুর খরনদ্বীপ ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের জ্যৈষ্ঠপুরা হারুনের বাড়ির বাসিন্দা। তার বাবার নাম অজিত দে। ইয়াছমিন আক্তার অ্যানির গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটের মোংলা থানায়। জীবিকার তাগিদে ইয়াছমিন নগরের ইপিজেড এলাকার ‘ক্যান পার্ক’ নামে একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করতেন। চাকরির সুবাদে তিনি বন্দরটিলা এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। বাবলু দে বন্দরটিলা এলাকায় ‘পূজা’ নামে একটি সেলুনে কাজ করতেন। প্রতিদিন বাসায় যাতায়াতের পথে ইয়াছমিনের সঙ্গে বাবলুর দেখা হতো। একপর্যায়ে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরিচয় গোপন রেখে বাবলু ২০১৯ সালে ইয়াছমিনকে বিয়ে করেন। তাদের সংসারে ইশা মনি নামে দেড় বছরের একটি কন্যাসন্তান রয়েছে।
এদিকে বিয়ের পর ইয়াছমিন জানতে পারেন তার স্বামী হিন্দু ধর্মের। এ নিয়ে তিনি চরম অনিশ্চয়তায় ভুগছিলেন। বিপরীতে বাবলু তার স্ত্রীকে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করেন। দুই বছর আগে বাবলু তার স্ত্রীকে নিয়ে বোয়ালখালী উপজেলায় বসবাস শুরু করেন। এরপর ইয়াছমিনের সঙ্গে পরিবারের যোগাযোগও বন্ধ হয়ে যায়। মৃত্যুর তিনদিন আগে ইয়াছমিন তার কাছের বান্ধবী ও খালাতো বোন হাসিকে ফোন করে জানান, তার স্বামী ধর্মান্তরিত হবেন। এজন্য তিন হাজার টাকা প্রয়োজন। হাসি বিষয়টি ইয়াছমিনের মাকে জানান। ইয়াছমিনের মা টাকা দিতে ব্যর্থ হলে বাবলু দে ক্ষিপ্ত হন।
সবশেষ গত ৩ আগস্ট বাবলু হাসিকে ফোন দিয়ে জানান, ইয়াছমিন স্ট্রোক করে মারা গেছে। হাসি বিষয়টি ইয়াছমিনের পরিবারকে জানায়। ঘটনা শুনে ইয়াছমিনের পরিবার দ্রুত রওনা দেয়। কিন্তু তখন দেশব্যাপী কঠোর লকডাউন চলায় আসতে বিলম্ব হয়।
এদিকে ইয়াছমিনের পরিবার আসার আগেই বাবলু তার স্ত্রী মুসলিম জেনেও স্থানীয় চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে পরামর্শ করে হিন্দু রীতি অনুযায়ী মরদেহ দাহ করেন। এ ঘটনায় নিহতের মা থানায় মামলা করতে গেলে আসামিরা প্রভাবশালী হওয়ায় পুলিশ আদালতে মামলা দায়ের করতে পরামর্শ দেয়। পরে বাদী মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের (বিএইচআরএফ) সহায়তায় আদালতে ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের করেন। আদালত অভিযোগটি বোয়ালখালী থানায় নিয়মিত মামলা হিসেবে রুজুর আদেশ দেন।
জানতে চাইলে বোয়ালখালী থানার ওসি আবদুল করিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আদালতের আদেশ পেয়ে ইয়াসমিন আক্তার নিহতের ঘটনায় থানায় হত্যা মামলা হয়েছে। শুক্রবার বিকেলে গ্রেফতার করা হয়েছে প্রধান আসামি ও নিহতের স্বামী বাবলু দে ওরফে তনুকে। ঘটনাটি তদন্ত করা হচ্ছে।’
মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জিয়া হাবিব আহসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাদী আর্থিকভাবে দুর্বল হওয়ায় মানবাধিকার সংগঠন বিএইচআরএফের সহায়তায় মামলা দায়ের করা হয়। এ ঘটনায় গ্রেফতার করা হয়েছে প্রধান আসামিকে। তিনি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ঘটনায় জড়িত অন্যদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানাচ্ছি।’
মিজানুর রহমান/জেডএইচ/জিকেএস