সাধারণ বেডও যেন ‘সোনার হরিণ’
মঙ্গলবার (৩ আগস্ট) দুপুর। রাজধানীর করোনা ডেডিকেটেড ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল-২ এর জরুরি বিভাগের সামনে দিয়ে সাইরেন বাজিয়ে প্রবেশ করছিল একের পর এক রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স। তাদের কেউ নোয়াখালী, কেউ ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কেউবা কেরানীগঞ্জ কিংবা নবাবগঞ্জ-দোহারসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য এখানে ছুটে এসেছেন।
তাদের মধ্যে কারও করোনা পরীক্ষা হয়েছে কারও ফুসফুসে সংক্রমণ দেখে চিকিৎসকরা করোনা সন্দেহে দ্রুত চিকিৎসার পরামর্শ দিয়ে ঢামেক হাসপাতালের করোনা ইউনিটে পাঠিয়েছেন।
তীব্র শ্বাসকষ্ট থাকায় ভাড়া করা অক্সিজেন সিলিন্ডার লাগিয়ে রোগীকে অ্যাম্বুলেন্সে শুয়ে-বসিয়ে স্বজনরা ছুটছেন সেখানকার জরুরি বিভাগের চিকিৎসকের কাছে। কিন্তু দু-তিন ঘণ্টা অপেক্ষার পরও অধিকাংশ রোগী ভর্তির সুযোগ পাচ্ছেন না। এদিকে অ্যাম্বুলেন্সচালকরা ভাড়া মিটিয়ে তাদের ছেড়ে দেয়ার জন্য বারবার রোগীর স্বজনদের তাগাদা দিচ্ছিলেন।
অন্যদিকে, উদ্বিগ্ন স্বজনরা তাদের রোগীকে ভর্তির জন্য চিকিৎসকের কাছে বারবার ধরনা দেয়ার পাশাপাশি মোবাইল ফোনে পরিচিত আত্মীয়স্বজনদের মাধ্যমে চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হচ্ছেন। চিকিৎসকরা প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়ে বাড়িতে নিয়ে চিকিৎসার পরামর্শ দিচ্ছেন। এ অবস্থায় ঢামেক হাসপাতাল করোনা ইউনিটের একটি সাধারণ বেডও যেন এখন ‘সোনার হরিণ’।
দুপুর ১২টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল-২ এর জরুরি বিভাগের সামনে একটি অ্যাম্বুলেন্সে শুয়ে আছেন কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা ৭৫ বছর বয়সী উর্ধক মণ্ডল। তার নাকে নল লাগানো। অক্সিজেন সিলিন্ডারের সাহায্যে দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস ফেলে ঘামছিলেন এ বৃদ্ধ। মাথার পাশে স্ত্রী বসে টিস্যু দিয়ে বারবার নাক-মুখ মুছে দিচ্ছিলেন। পাশেই বৃদ্ধ বাবার দুহাত শক্ত করে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন মেয়ে।
এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে উর্ধক মণ্ডলের স্ত্রী রঞ্জনা মণ্ডল জানান, কয়েক দিন ধরে তার স্বামীর জ্বর, ঠান্ডা ও কাশি। গতকাল থেকে শ্বাসকষ্ট বাড়লে রাজধানীর একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তি করান। সেখানে সিটি স্ক্যান করে ফুসফুসে সংক্রমণ ধরা পড়লে করোনা সন্দেহে দ্রুত ঢামেক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। কিন্তু এখানে এসে দুই ঘণ্টারও বেশি সময় বসে থাকলেও বেড ফাঁকা না থাকায় রোগীকে ভর্তি করাতে পারছেন না তারা।
বৃদ্ধ উর্ধক মণ্ডলকে হাসপাতালে ভর্তির জন্য তার মেয়েজামাই বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন বলে জানান রঞ্জনা। এদিকে রোগী নামাতে বিলম্ব হওয়ায় অ্যাম্বুলেন্সচালক বারবার তাগাদা দিচ্ছিলেন।
রাজধানীর খিলক্ষেত থেকে করোনা আক্রান্ত বাবা শাকিল আহমেদকে (৬০) ভর্তি করাতে নিয়ে এসেছেন ছেলে মাহিদুল ইসলাম। বেসরকারি একটি স্থানীয় হাসপাতালে তিন দিনে এক লাখ টাকার বেশি বিল দিয়ে মঙ্গলবার সকালে রিলিজ করিয়ে বাবাকে ঢামেক হাসপাতাল-২ এ নিয়ে এসেছেন ছেলে। কিন্তু বেড খালি না থাকায় চিকিৎসকরা প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়ে বাড়ি নিয়ে যেতে বলেছেন বলে জানান মাহিদুল। শুধু এ দুজন রোগীই নয়, শতকরা ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ করোনা রোগীকেই বেডের অভাবে ভর্তি করাতে পারছেন না চিকিৎসকরা।
রোগীর স্বজনদের অভিযোগ, ঢামেক করোনা ইউনিটে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা জরুরি বিভাগ থেকে এসে রোগীকে একবার চোখের দেখাও দেখেন না। ওয়ার্ডবয়কে পাঠিয়ে অক্সিজেন লেভেল পরীক্ষা করান এবং এর ভিত্তিতে চিকিৎসা দেন।
রোগীর স্বজনরা এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ঢামেক জরুরি বিভাগের সামনে দু-তিন সদস্যের চিকিৎসকদের একটি টিম থাকা প্রয়োজন। এখানে সিট না পেলে অন্য হাসপাতালে নিতে হতে পারে, আবার অ্যাম্বুলেন্স ছেড়ে দিলে অক্সিজেনের অভাবে রোগী মারা যেতে পারেন এমন আশঙ্কায় অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামাতে পারেন না রোগীর স্বজনরা। কিন্তু চিকিৎসকরা গো ধরে বসে থাকেন যে রোগীকে নামিয়ে তাদের কাছে নেয়া না হলে তারা দেখতে পারবেন না।
সাধারণ ওয়ার্ডবয়ের মাধ্যমে রোগীকে ডায়াগনসিস করে প্রেসক্রিপশন লিখে বাড়িতে নিয়ে চিকিৎসা দেয়া কতটুকু যুক্তিসঙ্গত তা নিয়েও তারা প্রশ্ন তোলেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ইউনিট-২) এবং বার্ন ইউনিট মিলিয়ে মোট বেড সংখ্যা ৬৩৯টি। রোগীর চাপ বাড়ায় অতিরিক্ত আরও ৬৬ জন অর্থাৎ বর্তমানে রোগী ভর্তি রয়েছেন ৭০৫ জন।
তিনি বলেন, হাসপাতালে ২০টি ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) এবং ৩৭টি হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিটের (এইচডিইউ) মধ্যে একটিরও বেড খালি নেই। রোগীর মৃত্যু হলে কিংবা সুস্থ হয়ে রোগী বাড়ি ফিরলে তবে নতুন রোগী ভর্তি করা যায়। এক্ষেত্রে প্রতিদিন সাধারণ বেডে খুবই স্বল্প সংখ্যক রোগী ভর্তি করা যায়।
এমইউ/এমআরআর/এমএস