নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করছেন টাইগার লোকমান

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ০৬:৫০ এএম, ১২ ডিসেম্বর ২০১৫

নিজের শোবার ঘরটি বানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংগ্রহ কেন্দ্র। এবার উদ্যোগ নিয়েছেন নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার। তাইতো এলাকার স্কুল-কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তিনি ছুটে বেড়াচ্ছেন। শোনাচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধের নানা ইতিহাস আর বীরত্বগাথা কাহিনী। বলছি মানিকগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধা টাইগার লোকমানের কথা। পুরো নাম লোকমান হোসেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় অসীম সাহসিকতার জন্য সহযোদ্ধারা তাকে দিয়েছেন টাইগার উপাধি। সেই থেকে টাইগার লোকমান নামেই পরিচিতি পুরো জেলায়।

লোকমানের বাড়ি মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার সিংজুরি ইউনিয়নের আশাপুর গ্রামে। কাঁচা আর ভাঙাচোরা রাস্তার পাশে কালীগঙ্গা নদী ঘেঁষা তার বাড়ি। ছোট্ট বাড়িটিতে দুটি থাকার ঘর। একটিতে ছেলে থাকেন। অন্যটিতে স্ত্রীসহ থাকেন লোকমান হোসেন। এই শোবার ঘরটিতেই লোকমান বানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংগ্রহ কেন্দ্র।

Lokman

২০০৮ সাল থেকে চারচালা টিনের পুরো ঘরই লোকমান সাজিয়েছেন জেলার বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি দিয়ে। শোভা পাচ্ছে যুদ্ধের সময়কার ঐতিহাসিক নানা ছবি। লোকমানের সংগ্রহশালায় ৫ শতাধিক মুক্তিযোদ্ধার ছবি স্থান পেয়েছে। যাদের মধ্যে অনেকেই আজ জীবিত নেই।

সংগ্রহশালা প্রসঙ্গে বীর মুক্তিযোদ্ধা লোকমান হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা চিরকাল বেঁচে থাকবেন না। কিন্তু বাংলাদেশ থাকবে। এমন এক সময় আসবে যখন কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে আর পাওয়া যাবে না। তখন নতুন প্রজন্ম এই সংগ্রহশালায় এসে বুঝতে পারবে কারা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তাদের চেহারাই বা কেমন ছিলো। জানবে যুদ্ধের নানা ইতিহাসও।

টাইগার লোকমানের স্বপ্ন স্মৃতি সংগ্রহকেন্দ্রটি পূর্ণাঙ্গ রূপ দেয়ার। যেখানে নিজের জেলার সকল মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধের স্থানসহ ইতিহাস সংরক্ষিত থাকবে। কিন্তু অর্থ সংকটে তার এ স্বপ্ন বাস্তবায়ন হচ্ছে না। তারপরও বসে থাকেননি একাত্তরের বীরযোদ্ধা লোকমান হোসেন। নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে এবং তাদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে তিনি ছুটছেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। `এসো মুক্তিযুদ্ধকে জানি ও মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনি` এই স্লোগানে তিনি শিক্ষার্থীদের শোনাচ্ছেন যুদ্ধের ইতিহাস।

Lokman

লোকমানের এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ দেখতে সরেজমিনে ঘিওর উপজেলার সিংজুরি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যায়। সকাল থেকেই একটা উৎসব উৎসব ভাব ছিল স্কুলটিতে। সবাই একত্রে জড়ো হয়েছিল স্কুল আঙ্গিনায়। ব্রেঞ্চে বসে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনলেন বীরসেনাদের গল্প।

সাবলীল ভাষায় লোকমানও শিক্ষার্থীদের শুনালেন যুদ্ধের সময়কার নানা গল্প আর ইতিহাস। মজার কথা শুনে হাত তালি দিয়ে যেমন আনন্দ করেছেন তেমনি হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের নানা বর্ববোরিত কাহিনী শুনে বিষাদ নেমে এসেছিল উপস্থিত শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও এলাকাবাসীর মধ্যে।

লোকমানের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে তার সাথে জড়ো হয়েছিলেন আরও বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। বীরমুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট দীপক কুমার ঘোষ মুক্তিযুদ্ধকালীন নানা স্লোগান দিচ্ছিলেন বার বার।

Lokman

লোকমান হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, স্বাধীনতার পর যারাই যখন ক্ষমতায় এসেছেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে করেছেন বিকৃত। তাই সারাদেশে না হোক  নিজ জেলার নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানাতেই তার এ উদ্যোগ। তিনি মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হলে দেশপ্রেমও জাগ্রত হবে তাদের মধ্যে।

এ কর্মসূচি পর্যায়ক্রমে মানিকগঞ্জের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চালাতে চান লোকমান হোসেন। নিজের মুক্তিযোদ্ধা ভাতার টাকা থেকে কিছু বাঁচিয়ে কর্মসূচির খরচ মেটান তিনি।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকের চাকরি ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন লোকমান হোসেন। ছোট-বড় বেশ কয়েকটি সম্মুখ যুদ্ধে তিনি অংশ নিয়েছিলেন। সিংগাইরের গোলাইডাঙ্গায় অনুষ্ঠিত মানিকগঞ্জের সবচেয়ে বড় মুক্তিযুদ্ধেরও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন টাইগার লোকমান। এই যুদ্ধে নিহত হয় ৮৩ জন পাকসেনা।

এসএস/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।