স্মৃতিতে রাজীব মীর
তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্বজন ও সুহৃদরা স্মরণ করলেন প্রয়াত কবি-শিক্ষক ও মানবাধিকারকর্মী রাজীব মীরকে। রাজীব মীরের সুহৃদদের উদ্যোগে আয়োজিত ভার্চ্যুয়াল স্মরণসভা অনলাইন সংবাদমাধ্যম আইপিনিউজর ফেসবুকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
সুহৃদেরা রাজীব মীরের সঙ্গে ঘটে যাওয়া নানান স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা স্মরণ করেছেন। স্মরণসভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌসের সঞ্চালনায় সভাপতিত্ব করেন বর্ষীয়ান রাজনীতিক ও ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য।
স্মরণসভার শুরুতে রাজীব মীরের কর্ম ও জীবনবৃত্তান্ত সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করেন বন্ধু ও প্রাবন্ধিক এবং অনুবাদক সুমু হক। পেশাগত জীবনে রাজীব মীর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতা করেছিলেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সংবাদপত্রে লেখালেখি করতেন এবং টেলিভিশনেও টক শো সঞ্চালনা করতেন।
রাজীব মীরের প্রকাশিত গ্রন্থগুলো হচ্ছে—১. জেন্ডার সাংবাদিকতা ২. ভোলা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ৩. সংবাদপত্রে শাহবাগ ৪. মিডিয়ার মন ৫. প্রেমে পড়েছে পাথর (কাব্য) ৬. শুধু তোমার জন্য লিখি (কাব্য) ৭. পুড়ে যাই উড়ে যাই (কাব্য) প্রভৃতি। ২০১৮ সালের ২১ জুলাই ৪২ বছর বয়সে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে মার যান রাজীব মীর।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নাসিরউদ্দিন বলেন, রাজীব মীর খুব সহজেই শিক্ষার্থীদের আপন করে নিতে পারতেন। তিনি অত্যন্ত সৃজনশীল মনের অধিকারী ছিলেন।
আলোচনায় অংশ নিয়ে বিশিষ্ট সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত বলেন, ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে আমি জানতাম যে রাজীব মীরের ক্লাস নির্ধারিত সময়ের বাইরেও বিলম্বিত হতো। সময় শেষ হয়ে গেলেও রাজীবের লেকচার শেষ হতো না। ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে জেনেছি, পাঠ্যপুস্তকের বাইরেও অনেক বিষয়ে তিনি কথা বলতেন। তাদের জ্ঞানের সীমাটা যাতে প্রসারিত হয়।
পাঠ্যবইয়ের বাইরেও অনেক বিষয়ে জ্ঞান রাখার জন্য ছাত্রছাত্রীদের বলতেন। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে রান্না করার অভিজ্ঞতাও তার আছে। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী রাজীব মীরের অনেক কিছু করার ছিল, যা তার অকালপ্রয়াণে সম্ভব হয়নি বলে মনে করেন এই সাংবাদিক।’
প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাংবাদিক সোহরাব হাসান বলেন, ‘রাজীব মীর সক্রিয়ভাবে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এবং মৌলবাদের বিপক্ষে সোচ্চার থাকতেন। তার বিরুদ্ধে একটি সংঘবদ্ধ অপপ্রচার হয়েছিল। সে কারণে তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনে আমাদের দায় রয়েছে।’
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অপর একজন শিক্ষক কামাল হোসেন বলেন, রাজীব মীর সব সময়ই রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে ছিলেন। হয়তো সে কারণেই তিনি নানান ষড়যন্ত্রের শিকারও হয়েছেন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের চেয়ারম্যান মো. আবদুল কাদের বলেন, রাজীব মীর সৃষ্টিশীল এক সম্ভাবনা ছিলেন। লেখালেখি করতেন। নানাভাবে মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করতেন। তার স্মৃতি যেন হারিয়ে না যায়, তার জন্য চেষ্টা করতে হবে।
আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, ‘রাজীব মীর আদিবাসীদের মানবাধিকারের জন্য নিবেদিত বন্ধু ছিলেন। আদিবাসীদের অধিকারের জন্য বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে গিয়েছেন। আমরা চেষ্টা করব তার প্রতি আমাদের যে দায়িত্ব রয়েছে, তা যথার্থভাবে পালন করতে।’
স্মরণ আয়োজনে রাজীব মীরের সহধর্মিণী সুমনা খান বলেন, ‘রাজীব মীর মানুষকে ভালোবাসতেন, তার প্রতিদান কিছুটা হলেও পেয়েছেন, যা তাকে নিয়ে এই স্মরণসভার আয়োজন দেখে বুঝতে পারছি।’ রাজীব মীর যে জন্য তার পেশাগত জীবনে বঞ্চনার শিকার হয়েছেন, তিনি খুব চাইতেন সেখান থেকে মুক্ত হতে। এই বঞ্চনা থেকে মুক্তি দিতে সবাই মিলে রাজীব মীরের স্বপ্নকে পূরণ করার আহ্বানও জানান তিনি।
স্মরণসভায় রাজীব মীরের কাব্যগ্রন্থ থেকে দুটি কবিতা পাঠ করে শোনান আদিবাসী অধিকার কর্মী মেইনথিন প্রমীলা ও এনটিভির অনুষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র ম্যানেজার জাহাঙ্গীর চৌধুরী। একে একে রাজীব মীরের জীবন ও কর্ম নিয়ে স্মৃতিচারণা করেন রাজীব মীরের বন্ধু ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৌরভ শিকদার, রাজীব মীরের ছাত্র সাইফুল, বিজু রায়, তার বোন নিপা, তাঁর সহপাঠী ড. আবু নাসের রাজীব, আদিবাসী নেতা এ্যান্ড্রু সলোমার প্রমুখ।
শেষে স্মরণসভার সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, ‘রাজীব ছিল প্রকৃত মানুষ, শিক্ষাব্রতী, ছাত্রদের ঘনিষ্ঠ এবং মানবতাবাদী। সে লেখালেখি করেছে, শিক্ষকতা করেছে। লেখালেখিতে সুদক্ষ ছিল। আদিবাসী ও প্রান্তিক সংখ্যালঘু মানুষের জন্য যে কজন বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষক ও নিবেদিতপ্রাণ মানুষকে আমরা পেয়েছি, তাদের মধ্যে রাজীব ছিলেন অন্যতম। তাকে বিস্মৃতির আড়ালে হারিয়ে যেতে দেয়া যাবে না।’
এমএসএম/এমআরএম/জেআইএম