আজ গোপালপুর ও ঘাটাইল মুক্ত দিবস


প্রকাশিত: ০৪:৫০ এএম, ১০ ডিসেম্বর ২০১৫

আজ ১০ ডিসেম্বর। টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুর উপজেলা ও ঘাটাইল উপজেলার ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল একটি দিন। এ দিন টাঙ্গাইলের এ দুটি অঞ্চল পাক হানাদার মুক্ত হয়।

১৯৭১ সালের মহান স্বধীনতা যুদ্ধের প্রায় ৮ মাস পাকহানাদার বাহিনী কর্তৃক গোপালপুরবাসী হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনের পর ১০ ডিসেম্বর মুক্তির স্বাদ লাভ করে। পাকিস্তানের দীর্ঘ ২৪ বৎসরের দুঃশাসন, বঞ্চনা, বৈষম্য, অত্যাচার, নির্যাতনের ফলে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বিশ্বের বুকে অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশ নামের দেশটির। ২৫ মার্চ ৭১`র কালো রাতে পাকহানাদার বাহিনী যে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে তার ধারাবাহিকতা সারা দেশে চালাতে থাকে। মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে গোপালপুরের বীর জনতা দেশের অবস্থা অনুধাবন করতে পেরে সংগঠিত হয়ে প্রশিক্ষণ শুরু করে।

টাঙ্গাইল জেলার উত্তরে অবস্থিত গোপালপুর থানা। ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর নিকরাইল রানী দিনমনি হাইস্কুলে ৭০ জন কমান্ডারের মিটিংয়ের পর কাদেরিয়া বাহিনী প্রধান বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী গোপালপুর থানা আক্রমণ করার জন্য কয়েকজন কোম্পানি কমান্ডারকে নির্দেশ দেন। নির্দেশ পাওয়া কোম্পানি কমান্ডারিা হলেন- নূর হোসেন তালুকদার আঙ্গুর কোম্পানি, আব্দুর রাজ্জাক ভোলা, আসাদুজ্জামান আরজু কোম্পানি, বকুল কোম্পানি, আব্দুল হাকিম কোম্পানি, নূরুল ইসলাম কোম্পানি, আনিসুর রহমান আনিস কোম্পানি এবং খন্দকার হাবিবুর রহমান কোম্পানি।

এদের মধ্যে চারটি কোম্পানির প্রতিনিধিদের নিয়ে পরামর্শ সভা করে গোপালপুর আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। পরিকল্পনা অনুসারে নূর হোসেন তালুকদার আঙ্গুর কোম্পানি গোপালপুর গরুহাটি দিয়ে আক্রমণ করবে। আসাদুজ্জামান আরজু কোম্পানি গোপালপুর দক্ষিণাংশ অর্থাৎ কীর্তনখোলা দিয়ে আক্রমণ করবে। আর আব্দুল হাকিম কোম্পানি পশ্চিম দিক থেকে মর্টার বাহিনী হিসেবে আক্রমণ করবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ৯ ডিসেম্বর গোপালপুর থানা আক্রমণ হয়।

১০ ডিসেম্বর দুপুর ৩ টায় ভারতীয় ৩টি মিগ-২১ বিমান গোপালপুর ও ঘাটাইল থানার উপর একযোগে ট্রাম্পিং করে। দুই থানার ক্যাম্পে অবস্থিত পাক সেনা ও রাজাকাররা বাঁচার তাগিদে রাতের আঁধারে গোপালপুর থেকে পালিয়ে যায়। এদিকে বিমান হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় গোপালপুর থানার সূতি, নন্দনপুর, ভূয়ার পাড়া, চরপাড়া, গোপালপুর গরুহাটিসহ বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান নেয়া মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদ দূরত্ব থেকে পাক সেনাদের ঘেরাও করে রেখেছিলেন। পাক সেনাদের পালিয়ে যেতে দেখে মিঞা কমান্ডার ও চাঁদ মিঞার প্লার্টুনের মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ধরার জন্য ধাওয়া করেন। প্রায় ১ ঘণ্টা গোলাগুলি হয়।

১০ ডিসেম্বর সকাল ১০টার মধ্যে শত্রু সেনা গোপালপুর থানা থেকে পালিয়ে যায়। বেলা ১১ টা ৩০ মিনিটে আরজু কোম্পানির চাঁদ মিঞার প্লার্টুনের মুক্তিযোদ্ধারা গুলি করতে করতে গোপালপুর থানায় প্রবেশ করেন। সেই সঙ্গে গোপালপুর থানা হানাদার মুক্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে। সর্ব প্রথম চাঁদ মিঞা, সাহেব আলী, শামছুল আলম, আব্দুল লতিফ, আজাহার, কাদের তালুকদার, তোরাপ সিকদার, ইসমাইল হোসেন মৃধা, আব্দুস সোবহান তুলা প্রমুখ গিয়ে থানায় উঠেন। পরে আসাদুজ্জামান আরজু কমান্ডার, বিমল, হায়দার, জয়নাল, শুকুর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে থানায় প্রবেশ করেন।

ইতোমধ্যে বিভিন্ন স্তরের মানুষ থানায় এসে মুক্তিযোদ্ধাদের অভিনন্দন জানান এবং তাদের সঙ্গে কোলাকোলি করেন। পরে মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি খাবারের ব্যবস্থা করেন। ১০ ডিসেম্বর শনিবার গোপালপুর থানা পাক হানাদার মুক্ত হয়। বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উড়ে।

অপরদিকে, আজকের এই দিনে টাঙ্গাইলের পাহাড়ী অঞ্চল খ্যাত ঘাটাইল হানাদার মুক্ত দিবস। দীর্ঘ ৯ মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধে ঘাটাইলের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কাদেরিয়া বাহিনী বিশেষ অবদান রাখেন এই এলাকায়। কাদেরিয়া বাহিনীর নেতৃত্বে যমুনা নদীতে পাকিস্থানি যুদ্ধ জাহাজ ধবংস করা হয়। এ সময় মুক্তিসেনারা ২১ কোটি টাকার গোলা বারুদ ও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র কব্জা করে মুক্তিযুদ্ধের নতুন দিগন্তের সূচনা করেন।

কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে কাদেরিয়া বাহিনী গঠিত হওয়ার পর ঘাটাইলের মুক্তিযোদ্ধারা কাদেরিয়া বাহিনীর সঙ্গে একীভূত হয়ে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে দুর্বার লড়াই গড়ে তুলে। মাকড়াই যুদ্ধে কাদের সিদ্দিকীর হাতে গুলি লাগলে তিনি মারাত্মক আহত হন। ৭ ডিসেম্বর ভুঞাপুর নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে নির্দেশ দেয়া হয় ৮ ডিসেম্বর রাত্রেই ঘাটাইলের প্রতিটি পাকবাহিনীর অবস্থানে এক যোগে আক্রমণ করা কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে।

এই মর্মে প্রতিটি কোম্পানি ও কোম্পানি কমান্ডারদের আক্রমণ স্থল নির্ধারণ করে দেয়া হয়। এই লক্ষ্যে ৫ হাজার মক্তিযোদ্ধাকে ৩০টি কোম্পানিতে বিভক্ত করে ৫টি মূল দলে ভাগ করে আক্রমণের স্থান নির্ধারণ করা হয়। ৮ ডিসেম্বর রাত ১১ টায় হাবিবুল হক বেনুসহ আরও একটি কোম্পানি রতনপুর অবস্থান নেয়। গোলাপের নেতৃত্বে ৩০/৪০ জন স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে বানিয়া পাড়া সেতুর পশ্চিম পাশে তেলেঙ্গাপাড়া গ্রামে অবস্থান নেয়।

৯ ডিসেম্বর কাদের সিদ্দিকীর নিদের্শ অনুযায়ী কালিদাস পাড়া, গুণগ্রাম, ঘাটাইল সদর ও বানিয়া পাড়া সেতু একযোগে আক্রমণ করা হবে। সে পকিল্পনা অনুযায়ী ভোর ৪টা থেকে ৬টা পর্যন্ত চতুর্দিক থেকে বৃষ্টির মত গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে ঘাটাইল থানা আক্রমণ করেন মুক্তিবাহিনী। পরে মেজর হাবিব ভোরে বানিয়া পাড়া সেতু, মেজর মোস্তফা কালিদাস পাড়া সেতু দখল করে ঘাটাইল থানার দিকে অগ্রসর হন। কাদের সিদ্দিকী নিজেই পশ্চিম দিক থেকে আক্রমণ করেন। এ যুদ্ধে ৫০ জন পাকহানাদার নিহত ও ১৫০ জন বন্দি হয়। এই দিন ঘাটাইল এর পাহাড়ি অঞ্চল পাক হানাদার মুক্ত হয়।

এসএস/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।