এই দিনে মুক্ত হয় নড়াইল
আজ ১০ ডিসেম্বর। নড়াইল মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে নড়াইলের মুক্তিপাগল দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সম্মুখ যুদ্ধে পরাজিত করে নড়াইলকে মুক্ত করে।
দিবসটি পালনের জন্য নড়াইল জেলা প্রশাসন, জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড ইউনিট, চিত্রা থিয়েটারসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণে স্বাধীনতার যে আহ্বান ছিল নড়াইলের মুক্তিপাগল জনতা তা থেকে পিছপা হয়নি। ওই সময় নড়াইলের এসডিওর বাসভবনকে স্থানীয় মুক্তিযুদ্ধের হাইকমান্ডের সদর দফতর করা হয়। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে তৎকালীন নড়াইলের এসডিও কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, এমএনএ খন্দকার আব্দুল হাফিজ, আওয়ামী লীগ নেতা এখলাছ উদ্দিন লোহাগড়া হাইস্কুলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও নড়াইলের সংগঠিত মুক্তিযোদ্ধাদের এক করে বিশাল বাহিনী যশোর অভিমুখে পাঠিয়ে দেন।
৬ এপ্রিল সকালে পাক হানাদার বাহিনীর দুটি জেট বিমান থেকে নড়াইল শহরের ওপর ব্যাপক গুলি ও বোমা নিক্ষেপ করলে শহর জনশুন্য হয়ে পড়ে। ১৩ এপ্রিল হানাদার বাহিনীর একটি দল নড়াইল শহরের চৌরাস্তায় রেস্টুরেন্ট মালিক মন্টুকে গুলি করে আহত করে এবং হরিপদ সরদার, ভাটিয়া গ্রামের কালু বোস, সরসপুর গ্রামের প্রফুল্ল মিত্রকে ধরে নিয়ে দাইতলা পুলের কাছে গুলি করে ফেলে রেখে চলে যায়। ওই সময় নড়াইলের জামায়াত নেতা শান্তি কমিটির সভাপতি মওলানা সোলায়মান এর নেতৃত্বে `শান্তিবাহিনী গঠিত` হয়। এদের নির্দেশে কয়েক হাজার মুক্তিকামী মানুষকে ধরে এনে জবাই করে হত্যা করা হয়।
ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকেই নবগঙ্গা নদীর উত্তর ও পূর্বাঞ্চাল হানাদার মুক্ত হয়ে যায়। লোহাগড়া থানা পাক হানাদার বাহিনীর ঘাঁটিকে ৬ ডিসেম্বরের মধ্যে মুক্তি বাহিনীর কমান্ডাররা আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিলে তারা আত্মসমর্পণ না করায় ৭ ডিসেম্বর শরীফ খসরুজ্জামান, দবির উদ্দিন, ইউনুস আহমেদ, লুৎফর মাস্টার, আলী মিয়া, লুৎফর বিশ্বাসসহ অনেক গ্রুপ একত্রিত হয়ে সম্মিলিতভাবে তিন দিক থেকে লোহাগড়া থানা আক্রমণ করলে প্রচণ্ড যুদ্ধের পর হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করলে লোহাগড়া মুক্ত হয়।
৯ ডিসেম্বর কালিয়া মুক্ত করে মুক্তিযোদ্ধারা নড়াইলে হানাদার বাহিনীর ঘাঁটির দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ৯ ডিসেম্বর নড়াইল শহরকে হানাদার মুক্ত করার জন্য পরিকল্পনা অনুযায়ী শেখ আজিবর রহমনের নেতৃতে একটি গ্রুপ চিত্রা নদীর পূর্ব দিক থেকে কাভারিং সাপোর্টে অন্য গ্রুপ সদর থানা লিডার শরীফ হুমায়ুন কবীর, সেলিম, হিলু, রানা, আমির হোসেন বর্তমান নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ চালালে পাল্টা আক্রমণে বাগডাঙ্গা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মতিয়ার রহমান শহীদ হন।
শহরের পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাংলোতে অবস্থানরত পাক মিলিটারিকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিলে তারা আত্মসমর্পণে অস্বীকার করেন। এ সময় মুক্তি বাহিনীর সদস্যরা চর্তুদিক থেকে প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ শুরু করলে পাক মিলিটারিরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এখানে কয়েকজন পাক মিলিটারি নিহত হয় এবং অন্যদের আটক করে জেলহাজতে পাঠানো হয়। প্রবল শীতকে উপেক্ষা করে মুক্তিযোদ্ধারা সারারাত শহরে বিজয় উল্লাস করতে থাকে ও জয় বাংলা স্লোগানে শহর প্রকম্পিত করে তোলে এবং ১০ ডিসেম্বর নড়াইলকে পাক হানাদার মুক্ত ঘোষণা করা হয়।
নড়াইলের মোট মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা-২৪২৮ জন। এর মধ্যে লোহাগড়া উপজেলায় ১২৯১ জন, কালিয়া উপজেলায় ৮২৫ এবং সদর উপজেলায় ৩১২ জন। যুদ্ধকালীন পাকবাহিনী ও রাজাকারদের সরঙ্গ যুদ্ধে শহীদ হন ৩১ জন। এদের মধ্যে লোহাগড়া উপজেলায় ২৪ জন, কালিয়া উপজেলায় ৪ এবং সদর উপজেলায় ৩ জন।
হাফিজুল নিলু/এসএস/পিআর