মালয়েশিয়ায় অবৈধ হওয়ার আশঙ্কায় বাংলাদেশিরা
মালয়েশিয়ায় বসবাসরত বাংলাদেশি শ্রমিকদের মাঝে চরম উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। আতঙ্কে দিনাতিপাত করছেন এসব প্রবাসী। সামনে ধেয়ে আসছে মহাবিপদ। ইল্লিগ্যাল ইমিগ্রান্ট কম্প্রিহেনসিভ সেটেলমেন্ট প্রোগ্রাম (সিক্স পি)-এর আওতায় বৈধতা পাওয়া মালয়েশিয়ায় কর্মরত প্রায় দুই লাখ ৬৪ হাজার বাংলাদেশির ওয়ার্ক পারমিটের মেয়াদ শেষ হতে চলেছে চলতি মাসে। মালয়েশিয়া সরকারের ফরেন ওয়ার্কার ডিভিশন ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে তাদের ওয়ার্ক পারমিট আর নবায়ন করা হবে না।
ফলে জানুয়ারি থেকে অবৈধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন প্রবাসী এই বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি কর্মী। বাংলাদেশ সরকার তাদের ওয়ার্ক পারমিট নবায়নের ব্যাপারে মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ এখনো না নেয়ায় ক্ষোভ বিরাজ করছে প্রবাসীদের মধ্যে।
তারা বলছেন, জানুয়ারিতে হয় তাদেরকে দেশে ফিরতে হবে নয় তো যেতে হবে জেলখানায়। মালয়েশিয়া প্রবাসী কর্মী ও বাংলাদেশি কমিউনিটি নেতারা জানান, অবৈধ হয়ে গেলে জেলে যাওয়ার আতঙ্ক বিরাজ করছে কর্মীদের মধ্যে।
এ দিকে বাংলাদেশ সরকার মালয়েশিয়ায় সরকার টু সরকার শ্রমিক পাঠানোর প্রক্রিয়ায় ভেস্তে যাওয়ার পর বিজনেস টু বিজনেস ফরমুলায় শ্রমিক পাঠানোর উদ্যোগ নেয়ায় জনশক্তি খাতের সাফল্য ম্লান হয়ে গেছে। বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে জনশক্তি রফতানি। এমন পরিস্থিতিতে জানুয়ারি থেকে মালয়েশিয়ায় অবৈধ হয়ে যাচ্ছে প্রায় সাড়ে তিন লাখেরও বেশি কর্মী।
একাধিক প্রবাসী কর্মী জানান, এ নিয়ে তাদের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। ওয়ার্ক পারমিটের মেয়াদ না বাড়লে জানুয়ারি থেকে তাদেরকে পালিয়ে থাকতে হবে। আর অবৈধ হয়ে যাওয়ায় তখন কোথাও চাকরি করতে গেলে বেতন পাবে অর্ধেকেরও কম। বাধ্য হয়েই গোপনে কম বেতনে কাজ করতে হবে গ্রেফতার হওয়ার ঝুঁকি নিয়ে। তার পাশাপাশি বাস করতে হবে জঙ্গলে।
এদিকে প্রতিদিন কোনো-কোনো এলাকায় রেইড দিচ্ছে ইমিগ্রেশন পুলিশ। যাদের কাগজপত্র রয়েছে তাদেরকে ছেড়ে দিচ্ছে। আর যাদের কাগজপত্র নেই তাদেরকে জেলখানায় নিয়ে যাচ্ছে।
এ ব্যাপারে মালয়েশিয়া বাংলাদেশ বিজনেস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও আওয়ামী লীগ নেতা রাশেদ বাদল বলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে এই বিপুল পরিমাণ কর্মীর ওয়ার্ক পারমিট নবায়ন করার সুযোগ করে দিতে না পারলে এক দিকে যেমন দেশে বেকারত্ব বাড়বে অন্যদিকে কমবে রেমিটেন্স।
তিনি বলেন, হাইকমিশন এ ব্যাপারে নিশ্চুপ রয়েছে। তারা কোন উদ্যোগই নিচ্ছে না। জানুয়ারিতে বিপুল পরিমান বাংলাদেশি কর্মীকে যাতে দেশে ফিরে যেতে না হয় সে জন্য সরকারকে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। আর সরকারি ব্যবস্থাপনায় বেসরকারি ভাবে শ্রমিক পাঠানোর ব্যবস্থা করা হলে এই কিন লাখেরও অধিক শ্রমিক ফিরে গেলেও পুনরায় তাদেরকে মালয়েশিয়ায় আনার উদ্যোগ নেওয়া উচিৎ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতার পর ২০১২ সালের ২৬ নভেম্বর মালয়েশিয়ায় জিটুজি প্রক্রিয়ায় শুধুমাত্র কৃষিখাতে কর্মী নিয়োগের লক্ষ্যে উভয় দেশের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এই প্রক্রিয়া চালাতে গিয়ে বিএমইটির কল্যাণ তহবিল থেকে প্রায় দুই কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ বনায়ন খাতে প্রথম দফায় জিটুজিতে বাংলাদেশ থেকে ৩০ হাজার কর্মী নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে।
সরকার তড়িঘড়ি করে ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে সারাদেশের ইউনিয়ন সেবা কেন্দ্রের মাধ্যমে ১৪ লাখ মালয়েশিয়া গমনেচ্ছু কর্মীর নিবন্ধন সম্পন্ন করে। ২০১৩ সালের ২৫ এপ্রিল জিটুজিতে প্রথম মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণ শুরু হয়। ২০১৩ সাল থেকে গত ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জিটুজি প্রক্রিয়ায় সর্বোচ্চ ৪৫ হাজার টাকা অভিবাসন ব্যয়ে মালয়েশিয়ায় মাত্র চার হাজার ৮শ’ ৯২ জন কৃষি কর্মী নিয়োগ পেয়েছেন। মালয়েশিয়া থেকে পর্যাপ্ত চাহিদাপত্র না আসায় নিবন্ধনকৃত অনেক কর্মীই হতাশ হয়ে পড়েছেন।
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেন, বাজার উন্মোচনের ঘোষণার দেড়-দুই মাসের মধ্যেই ‘বিটুবি’ সমঝোতা সই হতে পারতো। আমাদের এরকমই প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু, আমাদের দেশের জনশক্তি ব্যবসায়ীদের অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণেই ‘বিটুবি’ হয়নি। ‘বিটুবি’-এর আদলেই আমরা আবার ‘জিটুজি প্লাস’ চুক্তির প্রস্তুতি নিই। এটা নিয়েও তারা (জনশক্তি ব্যবসায়ী) অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। কেউ কেউ আবার অসংলগ্ন কথাবার্তাও বলছেন। ব্যক্তি স্বার্থকে না দেখে আমার মনে হয় দেশের স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দেয়া উচিত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জনশক্তি ব্যবসায়ী বলেন, ব্যবসা পাওয়ার জন্য যে কেউই প্রতিযোগিতায় নামতে পারেন। কিন্তু, এক্ষেত্রে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় সম্ভাবনাময় এই শ্রমবাজারটি নষ্ট যাতে না হয়, সে দিকেও খেয়াল রাখা উচিত।
মালয়েশিয়াস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন সূত্রে জানা গেছে, এর আগে বাংলাদেশের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর দৈরাত্ম্যের কারণে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। যেখানে ৫০টি ভিসার অনুমোদন ছিল সেখানে তারা (রিক্রুটিং এজেন্সি) সেটিকে একটা শূন্য বাড়িয়ে দিয়ে ৫০০ করে অতিরিক্ত সাড়ে ৪শ’ লোক পাঠিয়েছিল। এভাবে অতিরিক্ত লোক পাঠানোর কারণে সেদেশে গিয়ে একদিকে হাজার হাজার বাংলাদেশি যেমন রাস্তায় রাস্তায় অবস্থান করে মানবেতর জীবন যাপন করেছিলেন, তেমনি সে দেশের সরকারকেও বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়েছিল। তাই এ খাতে যাতে আর বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয় সে জন্য স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে (তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর) ভিসা প্রসেসিং থেকে শুরু করে কর্মী নেয়ার যাবতীয় কার্যক্রম তারা অনলাইনে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়।
মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার শহীদুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে বলেন, মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সে দেশে বসবাসরত অবৈধদের বৈধতা দেয় তিন বছর মেয়াদে। সে মেয়াদ শেষ হয়েছে গত বছর। তারপরে আরও এক বছর বাড়ানো হয় আলোচনার মাধ্যমে। এ মেয়াদ শেষ হচ্ছে এ বছর। বর্তমান সরকার প্রবাসীদের বেলায় আন্তরিক। আমরা নিশ্চুপ নয় অবৈধদের বৈধকরণের জোড়ালো প্রক্রিয়া চলছে। এতে আতঙ্কের কোনো কারণ নেই।
তিনি বলেন, সে দেশের ইমিগ্রেশন রেইড দিতেই পারে আর অবৈধদের গ্রেফতারের বেলায় আমাদের কিছুই করার নেই। তবে সতর্ক হয়ে চলাফেরার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার উন্মোচনের ব্যাপারে রাষ্ট্রদূত বলেন, মাননীয় প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রীর নেতৃত্বে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করছি। সুষ্ঠু ও যথাযথ পদ্ধতিতে যাতে বিপুল সংখ্যক কর্মী মালয়েশিয়ায় আসতে পারেন, তাদের সুযোগ-সুবিধা যাতে নিশ্চিত হয় সে জন্য কাজ করে যাচ্ছি। বাজারটি উন্মুক্ত হলে সবাই মিলেই ব্যবসা করতে পারবেন। এ খাতে যাতে কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সুযোগ তৈরি না হয়, সেভাবেই মাননীয় মন্ত্রীর নেতৃত্বে আমরা এগুচ্ছি।
বাংলাদেশি কমিউনিটি নেতা ও মালয়েশিয়া বিএনপির সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার বাদলুর রহমান খান বাদল বলেন, সরকার গত ৬ বছরে জিটুজির মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় মাত্র কয়েক হাজার কর্মী পাঠাতে পেরেছে। আর এটা না করে সরকারি নিয়ন্ত্রণে বেসরকারি খাতে দায়িত্ব দিলে কমপক্ষে দশ লাখ কর্মী আসতে পারতো। সরকারের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে বাংলাদেশ রেমিটেন্স থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
বাদল বলেন, সরকার যদি মনে করে মালয়েশিয়া জনশক্তি রফতানির গতি বাড়াতে হবে তাহলে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে স্বল্প অভিবাসন ব্যয়ের মাধ্যমে কর্মী পাঠানোর সুযোগ দিতে পারে। জাতীয় অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে হলে অবৈধদের বৈধতা এবং জনশক্তি রফতানির খাতকে রাষ্ট্রীয়ভাবে আরও পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে।
বিএ