ডিজিটাল সরকারের এনালগ চিন্তা!
বেশ কিছুদিন আগে একটি সংবাদ ফিচার পড়েছিলাম। বিজনেস ইনসাইডার ডট কমে প্রকাশিত ওই ফিচারটি বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায় অনেকটা এরকম- তিন বছর আগেও তিনি ছিলেন দেউলিয়া, পথে বসে গিয়েছিলেন তিনি, সেই জেল ফেরৎ আসামির আয় আজ মাসে দুই কোটি টাকারও বেশি। ওই ভদ্রলোকটি হলেন ডব্লিউটিএফ ম্যাগাজিন ও ফানিয়ারপিকস ডটনেটের প্রতিষ্ঠাতা ৪০ বছর বয়সী জেসন ফিক। তিনি কী করে ঘুরে দাঁড়ালেন? জবাব একটাই, ফেসবুকের যথাযথ ব্যবহার। তিনি স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে চলেছেন।
ভারতের ইকোনমিক টাইমসের খবর- ফেসবুক এখন ব্যবসার বড় মাধ্যম। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত অনেক উদ্যোক্তা এখন পণ্যের বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে ফেসবুককেই প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করছেন। ভারতে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের প্রায় ৫৬ শতাংশই ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তরুণদের চেয়ে ব্যবসায়ীদের কাছেই বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ফেসবুক। ফেসবুক এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ব্যবসাকে তাদের লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করতে চেষ্টা করা হচ্ছে।
এবার দেখে নেই বাংলাদেশের অনলাইন সংবাদপত্র বিডিনিউজ টোয়েন্টি ফোর ডটকমের খবর: ‘মঙ্গলবার তারা এমন স্বপ্নবাজ মানুষদের নিয়ে একটি সংবাদ প্রচার করেছে। তাদের সংবাদের শুরুটা এরকম- নিরাপত্তার স্বার্থে ফেসবুক বন্ধ রাখায় বিপাকে পড়েছেন এই যোগাযোগ মাধ্যম ভিত্তিক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও ফ্রিল্যান্সাররা। তাদের কেউ কেউ বলেছেন, দুই সপ্তাহের মধ্যেই স্বল্প পুঁজি নিয়ে দেখা স্বপ্ন ফিকে হতে শুরু করেছে। আউট সোর্সিংয়ের কাজ করা ফ্রিল্যান্সার সাইদুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন,আমরা যারা ক্ষুদ্র পরিসরে আউট সোর্সিংয়ের কাজ করি, আমরা সম্পূর্ণ শেষ। আমাদের পুরো কাজগুলোই আসতো ফেসবুকের মাধ্যমে। ফেসবুক বন্ধ থাকায় আমাদের পথে বসার মতো অবস্থা’
যুক্তরাষ্ট্রের জেসন ফিক পথেই বসেছিলেন। তিনি দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিলেন। ফেসবুক ব্যবহার করে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। আর ফেসবুক বন্ধ থাকায় বাংলাদেশের সাইদুল ইসলাম এখন পথে বসছেন। এই দুটো ঘটনার মাঝখানে রয়েছে দেশের নিরাপত্তার ঝুঁকি। সরকার তাই মনে করছে। ফেসবুক ব্যবহারকারীদের একটা অংশ দেশের মানুষকে নিরাপত্তাহীনতার ম্যধে ফেলে দিয়েছে বলেই সরকারের বিশ্বাস।
গত ১৮ নভেম্বর থেকে ফেসবুকসহ বেশ কয়েকটি আ্যপস বন্ধ করে দেয় সরকার। এ বছরের শুরুতেও বিএনপি জামায়াতের অবরোধ কর্মসূচির সময় নিরাপত্তার অজুহাতে ভাইবার, ট্যাংগো, হোয়াটসঅ্যাপ,মাইপিপল ও লাইন নামের পাঁচটি অ্যাপসের সেবা বন্ধ করে দিয়েছিল সরকার। বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা এসব অ্যাপস ব্যবহার করে যোগাযোগ করতেন বলে সরকার ওই রকম সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ২০১২ সালে ইউটিউবও কিছুদিনের জন্য বন্ধ করে দিয়েছিল। সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালে কারফিউ জারি করে মোবাইল ফোন সেবাও কিছু সময়ের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। অপরাধ কি কমেছে?
দুই সপ্তাহ পার হচ্ছে এই মাধ্যমটি বন্ধ রয়েছে। টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী বলছেন, ফেসবুকের সঙ্গে সরকার একটি চুক্তিতে আসতে চায়। এজন্য আলোচনা করার আগ্রহ জানিয়ে ফেসবুক কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি পাঠিয়ে সাড়াও পেয়েছে সরকার। মানহানিকর কনটেন্ট, নারীর প্রতি অবমাননা, রাজনৈতিক অপপ্রচার ও জঙ্গি কার্যক্রমে উৎসাহ দিয়ে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির নানা চেষ্টা ফেসবুকের মাধ্যমে ঘটে বলে অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু ফেসবুকের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো ধরনের চুক্তি না থাকায় ফেসবুকের অপব্যবহারের মাধ্যমে ঘটা এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না।
তাহলে কী বিষয়টি এরকম দাঁড়াচ্ছে যে যতদিন চুক্তি না হবে ততদিন এই জনপ্রিয় মাধ্যমটি বন্ধ থাকবে? বিষয়টি কতটা জটিল করা যায় সরকার সেরকম সব চিন্তাই করছে। যেমন সেদিন তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী বললেন, ফেসবুক একাউন্ট খুলতে জাতীয় পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক করার চিন্তাভাবনা করছে সরকার। তিনি জানান, স্মার্ট ন্যাশনাল আইডি কার্ড প্রকল্প চালু হলে ইমেইল আইডির সঙ্গে ন্যাশনাল আইডি কার্ড ভেরিফিকেশনের জন্য নতুন অপশন যোগ করতে ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করবেন। কবে স্মার্ট কার্ড হবে তারই ঠিক নেই। কবে চুক্তি হবে, সরকারের কথামত ফেসবুক চুক্তি করবে কিনা, আর চুক্তি হলেই কী অপরাধীরা চুপ করে বসে থাকবে?
ফেসবুক বাংলাদেশে সবচে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। বর্তমানে এক কোটি সত্তর লাখ বাংলাদেশির নামে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। দিনকে দিন এই সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আর এদের প্রায় অর্ধেক বয়স ১৮ থেকে ৩০-এর ঘরে। এই মাধ্যমটি ব্যবহার করে মানুষ যেখানে কোটিপতি হচ্ছে আবার কেউ কেউ এটি ব্যবহার করে অপরাধও করছে। এখন প্রশ্ন হলো বাংলাদেশ কী করবে? গুটি কয়েক অপরাধীকে ঠেকাতে প্রায় দুকোটি মানুষকে ঠেকিয়ে রাখবে?
সম্প্রতি কথা হচ্ছিল গোয়েন্দা পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলামের সঙ্গে। যিনি নিজেও নিয়মিত ফেসবুক ব্যবহার করেন। তিনি জানালেন, ব্লগার হত্যাকারি কয়েকজনকে আটক করে তারা জানতে পেরেছেন, খুনিদের ওই গ্রুপটি এখন কোনোরকম তথ্য প্রযুক্তিই ব্যবহার করে না। ব্লগার রাজীব হত্যায় মোবাইল ফোন ব্যবহার করে আসামীরা ধরা পড়ার পর তারা ওই কৌশল নিয়েছে। এখন তারা এনালগ আমলের মতো ম্যান টু ম্যান অর্থাৎ ব্যক্তিগতভাবে দেখা সাক্ষাৎ করে যোগাযোগ করছে। যে কারণে ওইসব খুনিদের সহজে ধরা যাচ্ছে না।
তাই বলছি প্রযুক্তির অসৎ ব্যবহার ঠেকাতে এ থেকে বিযুক্ত হওয়া কোনো সমাধান নয়। অপরাধীদের চেয়ে সরকারকে আরো বেশি স্মার্ট হতে হবে। ডিজিটাল থেকে এনালগে ফিরে যাওয়া সভ্যতারই বিপক্ষে হাঁটা।
এইচআর/পিআর