ঝালকাঠির আদালতে ১৬২৯টি মামলা বিচারাধীন
২০১১ সালের ২৩ মার্চ। এদিন একাদশ শ্রেণির ছাত্র লিমন হোসেন র্যাবের কথিত বন্দুকযুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হয়। ২৭ মার্চ ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে লিমনের একটি পা কেটে ফেলা হয়। ২০১১ সালের ১০ এপ্রিল লিমনের মা তার ছেলেকে পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে দাবি করে র্যাব ৮ এর উপ-সহকারী পরিচালক (ডিএডি) লুৎফর রহমানসহ র্যাবের ৬ সদস্যের বিরুদ্ধে ঝালকাঠির সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি নালিশি মামলা দায়ের করেন।
আদালতের বিচারক অভিযোগটি রাজাপুর থানা পুলিশের ওসিকে এফআইআর হিসেবে রেকর্ড করার নির্দেশ দেন। আদালতের নির্দেশ সত্যেও রাজাপুর থানার ওসি ১৫ দিনেও মামলা রেকর্ড করেননি। বিষয়টি আদালতের নজরে আনা হলে আদালত ওসিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মামলা রেকর্ড করে আদালতকে অবহিত করার নির্দেশ দেন। এই আদেশের পর ২০১১ সালের ২৬ এপ্রিল ৬ র্যাব সদস্যর বিরুদ্ধে রাজাপুর থানায় মামলা রেকর্ড করা হয়।
২০১২ সালের ১৪ আগস্ট রাজাপুর থানা পুলিশের এসআই আব্দুল হালিম তালুকদার ৬ র্যাব সদস্যকে লিমন হত্যা প্রচেষ্টা মামলা থেকে অব্যাহতির সুপারিশ করে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। পুলিশের এ চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে লিমনের মা হেনোয়ারা বেগম ২০১২ সালের ৩০ আগস্ট সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে নারাজি আবেদন দাখিল করেন।
২০১৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত নারাজি খারিজ করে দেন। একই বছরের ১৯ মার্চ হেনোয়ারা বেগম ঝালকাঠির জেলা ও দায়রা জজ আদালতে নারাজি খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে রিভিশন দায়ের করেন। লিমনের মায়ের পক্ষে বিভিন্ন সময়ে মামলা পরিচালনা করেন ঢাকা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের আইনজীবী মু. আব্দুর রশিদ, ঝালকাঠির আইনজীবী মল্লিক মুু. নাসির উদ্দিন কবির, নাসিমুল হাসান, আককাস সিকদার, মানিক আচার্য্য ও হাসান সিকদার।
এদিকে লিমন গুলিবিদ্ধ হয়ে পঙ্গু হওয়ার পর র্যাবের ডিএডি লুৎফর রহমান বাদী হয়ে লিমনের বিরুদ্ধে দুটি মামলা দায়ের করেন। এর একটি অস্ত্র আইনে অপরটি সরকারি কাজে বাধা দানের অভিযোগে। পুলিশ দুটি মামলায় লিমনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান, আইন ও সালিশ কেন্দ্রসহ দেশের বিশিষ্টজনদের সমালোচনার মুখে সরকার লিমনের বিরুদ্ধে দায়ের করা দুটি মামলা প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেয়। সরকারের এ সিদ্ধান্তে আদালতে সরকারি কৌঁসুলি আব্দুল মান্নান রসূল মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করেন।
এ আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের ২৯ জুলাই অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ কিরণ শংকর হালদার অস্ত্র মামলা থেকে এবং ২০১৪ সালের ১৬ অক্টোবর চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. আবু শামীম আজাদ সরকারি কাজে বাধা দানের মামলা থেকে লিমনের নাম প্রত্যাহারের আদেশ দেন। লিমন বর্তমানে ঢাকার গণ-বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিষয়ের শিক্ষার্থী। মামলার নথি পর্যালোচনা ও আইনজীবীদের কাছ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
লিমন বলেন, প্রধানমন্ত্রী অথবা কোনো পৃষ্ঠপোষকতা পেলে দরিদ্র ঘরের সন্তান হিসেবে দারিদ্রতাকে জয় করে লেখাপড়া করে ব্যারিস্টার হতে চাই। যেদিন থেকে আমি আইনের মাধ্যমে ন্যায় বিচার পাচ্ছিলাম না সে দিন থেকেই ব্যারিস্টার হওয়ার আশা করেছি। কারণ আমার মতো হাজারো লিমন পঙ্গু হয়ে ন্যায় বিচার পাবার জন্য আদালতের কাছে জিম্মি থাকে। কিন্তু ন্যায় বিচার পাওয়া তাদের পক্ষে আদৌ সম্ভব হয়না। আমি ব্যারিস্টার হয়ে তাদেরকে আইনের মাধ্যমে সুবিচার দিব।
লিমন আরো জানান, র্যাবের গুলিতে একটি পা হারাই, তখন ছিলাম এইচএসসি (ভোকেশনাল) প্রথম বর্ষের পরীক্ষার্থী। ওই বছর পরীক্ষা দেয়া তো দূরের কথা হাসপাতাল আর আদালতের বারান্দায় কেটেছে পড়ালেখা করার গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো। তবে একের পর এক মামলা আর হয়রানি দমাতে পারেনি। সব বাধা উপেক্ষা করে পরীক্ষায় অংশ নিয়ে জিপিএ ৪ পেয়েছি। সরকারি বা বেসকারি পৃষ্ঠপোষকতায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে ব্যারিস্টার হওয়ায় আশা করছি।
এতো গেল লিমনের কাহীনি। তার মতো অসংখ্য লিমন প্রতিদিন বিচারের আশায় ঘুরছে ঝালকাঠির আদালতে।
আদালত সূত্র জানিয়েছে, ঝালকাঠির আদালতে ১৬২৯টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। বিচারক শুন্য, ছুটিতে থাকা, সরকারি বন্ধ, আইনজীবীদের ব্যবসায়িক খামখেয়ালিপনার কারণে মামলার দীর্ঘ সূত্রিতায় জড়িয়ে লিমনের মতো হাজারো পরিবার দিনের পর দিন সময় শেষ করে আদালতের বারান্দায়। বর্তমানে সিনিয়র সহকারী জজ ঝালকাঠি সদর এবং সহকারী জজ রাজাপুর আদালতের বিচারক শুন্য রয়েছে।
এ ব্যাপারে ঝালকাঠি সদর আদালতের এপিপি অ্যাডভোকেট সঞ্জয় মিত্র বলেন, অনেক মামলা আছে যা জেলা ও দায়রা জজ আদালত ছাড়া জামিন অযোগ্য। এজন্য মামলা নিষ্পত্তি তো দূরের কথা জামিন পেতেই মামলার ধরন অনুযায়ী ১৫ থেকে দেড়-দু মাস সময় লাগে।
জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট আব্দুল মান্নান রসূল বলেন, অন্য আদালতের অনেক মামলায় জামিন দেয়ার এখতিয়ার নেই। এই মামলাগুলো আইনি প্রক্রিয়া শেষ করে জেলা জজ আদালতে আসতেই মাস পার হয়ে যায়। আবার জেলা জজ আদালতে আসলেও মামলার ধারা অনুযায়ী কত দিনে জামিন পাবার যোগ্য তাও আদালতের বিবেচ্য বিষয়।
এমএএস/আরআইপি