বন্দুকযুদ্ধে নিহত হোজ্জার নামের শেষ নেই
সবাই জানতো তিনি ঢাকায় হারবাল ওষুধ বিক্রি করেন। তিন-চার মাস পর পর বাড়ি আসতেন। গ্রামে এলে এলাকার লোকজনের সঙ্গে খুব সৌহার্দ্যমূলক আচার-আচরণ করতেন। ধর্মে-কর্মে দারুণ মনোযোগী ছিলেন। কিন্তু তার মাঝে এক ধরনের অস্বস্তি কারো নজর এড়ায়নি। এলাকার সবাই তাকে আব্দুল্লাহেল বাকী ওরফে বাকী নামেই জানে। এই বাকী ঢাকায় গিয়ে বনে যান জেএমবি কমান্ডার ‘আলবানি’ ওরফে ‘হোজ্জা ভাই’। কোথাওবা তার নাম ‘মাহফুজ’ আবার কোথাও ‘মেম্বার ভাই’।
কারো কাছে তার পরিচয় ‘হাসান’ নামে কেউবা তাকে চেনে ‘শাহাদাত’ নামে। কোথাওবা আবার তিনি ‘রাজু’ নামে পরিচিত। এসবই তার ছদ্মনাম। এরকম সাতটি নাম খুঁজে পাওয়া গেলেও জেএমবি কমান্ডার ‘আলবানি’ ওরফে ‘হোজ্জা ভাই’ তার নিজ এলাকা শেরপুরের নকলা উপজেলার চরঅষ্টধর ইউনিয়নের কাজাইকাটা গ্রামের লোকজন তাকে ‘বাকী’ নামেই চেনে।
ঢাকার দারুচ্ছালাম রোডে তিনদিন আগে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত এই জেএমবি কমান্ডারের লাশ ২৮ নভেম্বর শনিবার কাজাইকাটা গ্রামের স্থানীয় গোরস্থানে দাফন করা হয়েছে।
সাভারে পুলিশ হত্যা, আশুলিয়ায় ব্যাংক ডাকাতি, হোসনি দালানে শিয়াদের তাজিয়া মিছিলে বোমা হামলাসহ দুর্ধর্ষ সব অপরাধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নাম ওঠে আসে জেএমবি কমান্ডার আলবানি, ওরফে হোজ্জা ভাই ওরফে মাহফুজ ওরফে বাকীর নাম।
ঢাকার দারুচ্ছালাম রোডের দ্বীপনগর বালুর মাঠে বুধবার রাতে গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে জেএমবি কমান্ডার বাকী মারা যায়। সে ছিলো জেএমবি’র সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্য। শুক্রবার রাত নয়টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গ থেকে নিহত বাকী ওরফে আলবানি ওরফে হোজ্জাভাই ওরফে মাহফুজের লাশ তার বড় ভাই মাসুদ ও নুর মোহাম্মদ নিয়ে আসেন।
শনিবার ভোর চারটায় লাশ নিয়ে তারা নকলার কাজাইকাটা গ্রামের বাড়িতে পৌঁছান। সকাল ৯টায় কাজাইকাটা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জানাযা শেষে বিদ্যালয়ের পাশ্ববর্তী স্থানীয় গোরস্থানে লাশ দাফন করা হয়। ছোটভাই ইসমাইল হোসেন জানাযায় ইমামতি করেন।
শনিবার দুপুরে কাজাইকাটা গ্রামে গিয়ে পরিবারের সদস্য ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কাজাইকাটা এলাকার অধিকাংশ লোক আহলে হাদীস সম্প্রদায়ভূক্ত। সেখানকার বড় বাড়ির মৃত মজিবর রহমানের ৫ সন্তানের তৃতীয় আব্দুল্লাহেল বাকী। পাশ্ববর্তী কুটেরচর জুনাব আলী চৌধুরী মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাশ করার পর ২০০২ সালের দিকে বাকী ঢাকায় চলে যায়। মাদ্রাসায় পড়াকালীন সে ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। এরপর থেকে সে ঢাকাতেই থাকতো এবং মাঝে মাঝে বাড়িতে আসতো।
২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারাদেশে জেএমবির সিরিজ বোমা হামলার সময় থেকে তার মাঝে অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ্য করা যায়। এনিয়ে পরিবারের অন্যান্য ভাইদের সঙ্গেও তার দুরত্ব তৈরি হয়। অন্যান্য ভাইয়েরা ঢাকায় কেউ গার্মেন্টসে, কেউ কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে চাকরি করলেও বাকিদের সাথে তাদের তেমন যোগাযোগ ছিলনা। তারা জানতেন, সে হারবাল ওষুধের সেলসম্যানের কাজ করে। এলাকায়ও সে মাঝে মাঝে হারবালের ওষুধ এনে বিক্রি করেছে। তিন বছর আগে ফুলপুরের চর গোয়াডাঙ্গা এলাকার জামায়াতের এক শুরা সদস্যের মেয়েকে সে বিয়ে করে। স্ত্রী গ্রামের বাড়িতেই থাকতো। নয় মাস বয়সী তার একটি কন্যা সন্তান রয়েছে।
কিন্তু প্রায় আট মাস আগে ঢাকার আশুলিয়ায় ব্যাংক ডাকাতির ঘটনার সময় গোয়েন্দা পুলিশ নকলার কাজাইকাটর বাড়িতে কথিত মাহফুজ ওরফে বাকীর সন্ধানে অভিযান চালায়। এসময় তাকে না পেয়ে তার স্ত্রী ও বড় ভাই নূর মোহাম্মদকে ধরে নিয়ে যায়। ১২ দিন তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বাকীর স্ত্রী-ভাইকে ছেড়ে দেওয়া হয়। সে সময় তার ভাইরা পুলিশের কাছ থেকে অবগত হন বাকী জেএমবির সঙ্গে জড়িত। তারা বাকীর আরো ৭/৮টি নামের ব্যাপারেও অবগত হন।
বাকীর বাড়িতে গেলে তার ভাই মাসুদ ও নূর মোহাম্মদ জানান, আমরা জানতাম সে হারবাল ওষুধের সেলসম্যান। কিন্তু কোথায় থাকে, কত বেতন পায় সে সসম্পর্কে কোনো খোঁজ রাখতে চেষ্টা করিনি। ও তারটা করে খায় আমরা আমাদেরটা করে খাই। ব্যস এটুকুই। মিডিয়ায় সংবাদ দেখে শুক্রবার ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে লাশ সনাক্ত করার পর বাড়ি এনে দাফনের ব্যবস্থা করেছি। এনিয়ে আমাদের কিছু বলার নেই। যেটা হবার সেটা হয়ে গেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা কৃষক আবু তালেব জানান, আমরা বাকী নামেই তাকে চিনি। শুনেছি সে ঢাকায় পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে। সে অনেকদিন ধরে ঢাকায় থাকতো, তবে এলাকায় আসলে তার আচার-আচরণ ভালো ছিল। সে হারবাল ওষধ বিক্রি করতো বলেই আমরা জানতাম। তবে কাজাইকাটা কাররি মোড় এলাকার একটি দোকানের সামনে বসে কথা প্রসঙ্গে ৭/৮ জন স্থানীয় বাসিন্দা জানান, সে বাকী নামে এলাকায় পরিচিত ছিলো। সে ছাত্রজীবনে শিবির করতো। এরপর সে জেএমবিতে যোগ দেয়। তার কথাবার্তা এবং চালচলন ভালো হলেও ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সিরিজ বোমা হামলার সময় থেকেই সে জেএমবির সঙ্গে জড়িত। হঠাৎ হঠাৎ সে গ্রামের বাড়িতে আসতো, তবে খুব বেশী থাকতো না।
এ ব্যাপারে নকলা থানা পুলিশের সেকেন্ড অফিসার মো. সারোয়ার হোসেন বলেন, বাকী ঢাকায় নিহত হয়েছে। গোয়েন্দা রিপোর্টে সে জেএমবি’র সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্য ছিল বলে তথ্য রয়েছে।
হাকিম বাবুল/এমএএস/আরআইপি