ঋণের বোঝা দ্বিগুণ, অবস্থা সামলাতে হিমশিম শহুরে-নতুন দরিদ্ররা
মহামারি করোনা সংক্রমণের এক বছর পার হয়েছে। কিন্তু ঋণের জালে জড়িয়ে এবং সঞ্চয় হারিয়ে বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী এখনও তাদের দৈনন্দিন জীবন চালাতে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করছেন। বিশেষ করে শহুরে বস্তিবাসীদের অবস্থা বেশ ভয়াবহ। শহুরে বস্তিতে কোভিড-পূর্ব অবস্থার আয়ের চেয়ে এখনকার আয় ১৪ শতাংশ কম।
২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশান রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অফ গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (বিআইজিডি) এর করা যৌথ গবেষণার তৃতীয় ধাপে পাওয়া গেছে এমন বেশ কিছু তথ্য।
দেশে বিদ্যমান দারিদ্র্য-সংকট নিয়ে পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান এবং বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ইমরান মতিন মঙ্গলবার (২০ এপ্রিল) ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেন।
টেলিফোনের মাধ্যমে দেশব্যাপী তিন ধাপে করা এই জরিপে করোনার কারণে সৃষ্ট দারিদ্র্যের গতিপ্রকৃতি এবং স্বল্প আয়ের মানুষদের মাঝে এর প্রভাব সম্পর্কে গবেষণা করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, মহামারির কারণে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নানান শ্রেনীপেশার মানুষ। এদের মধ্যে রয়েছেন হতদরিদ্র এবং মাঝারি দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ। এদের অবস্থান দারিদ্র্যসীমার নিচে। এ ছাড়া রয়েছেন দরিদ্র নয় কিন্তু ঝুঁকিতে থাকা এক শ্রেণীর মানুষ, যাদের বলা হচ্ছে ভালনারেবল নন পুওর বা ভিএনপি।
গবেষণায় দেখা গেছে, দারিদ্র্যসীমার উপরে কিন্তু মধ্যম জাতীয় আয়সীমার নিচে থাকা এই শ্রেণীর মানুষদের অবস্থা পরিবর্তিত হচ্ছে সবচেয়ে ধীরগতিতে। গত বছরের জুনে দরিদ্র নয় কিন্তু সেই ঝুঁকিতে থাকা এই মানুষদের ৭২ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছিলেন। তাদের আখ্যায়িত করা হয়েছিল ‘নতুন দরিদ্র’ হিসেবে। সেই ‘নতুন দরিদ্রদের’ ৫০ শতাংশ এখনও ঝুঁকিতে থাকা মানুষের তালিকায় বিদ্যমান। এই হার শহরে ৫৯ শতাংশ এবং গ্রামে ৪৪ শতাংশ। বর্তমানে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ ‘নতুন দরিদ্রের’ এই হার গত বছরের জুনে ছিল ২১ দশমিক ২ শতাংশ।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, যদিও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে গত জুন মাস থেকে উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তারপরও করোনার পূর্বে কাজ ছিল কিন্তু এখন বেকার এমন মানুষ রয়েছেন ৮ শতাংশ। কর্মহীনতার এই ধারা নারীদের জন্য বেশ আশঙ্কাজনক। করোনার আগে কর্মজীবি ছিলেন এমন নারীদের এক-তৃতীয়াংশ গত বছরের জুন মাস থেকে এখনও বেকার। পুরুষদের ক্ষেত্রে এই হার নেমে এসেছে ১৬ শতাংশ থেকে ৬ শতাংশে।
‘স্বল্প আয় এবং বেকারত্বের পাশাপাশি কর্মসংস্থান পুনরুদ্ধারের প্রকৃতি বদলে যাওয়াটাও একটি বড় চিন্তার বিষয়। করোনার কারণে অনেককেই তাদের পেশা পরিবর্তন করতে হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, এদের অধিকাংশই ‘অদক্ষ শ্রমিক’ হিসেবে নতুন পেশা গ্রহণ করেছে। যেমন- অনেক ক্ষেত্রে দক্ষ শ্রমিক, বেতনভুক্ত কর্মী এবং কারখানার কর্মীরা দিনমজুর হিসেবে কাজ শুরু করেছেন।’
এসময় ড. ইমরান মতিন তার বক্তব্যে নারীদের কর্মহীনতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘এমনিতেই দেশের শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ কম। আর কোভিড-সৃষ্ট এই অবস্থা নারীদের শ্রমবাজার থেকে আরও ছিটকে ফেলতে পারে। পেশা পরিবর্তন করে দিনমজুরের মতো ঝুঁকিপূর্ণ পেশা গ্রহণ করায় দরিদ্রদের দুরবস্থা আরও বাড়ছে।’
গবেষণায় দেকা গেছে, শুধুমাত্র কৃষিখাতই বলা চলে কোভিড-পূর্ব অবস্থার মতো ইতিবাচক অবস্থান গড়তে পেরেছে। শহরে আয়ের সুযোগ হ্রাস পাওয়ায় বস্তি থেকে গ্রামে চলে যাওয়ার ঘটনা প্রচুর ঘটেছে। গত বছর ২৭ দশমিক ৩ শতাংশ বস্তিবাসী শহর ছেড়েছিলেন, যাদের ৯ দশমিক ৮ শতাংশ এখনও ফেরেননি। প্রাক-কোভিড অবস্থার তুলনায় আয় কমলেও খাবারের ব্যয় বাদে দৈনন্দিন যে ব্যয় সেটি গত জুন থেকে দ্বিগুন হয়েছে। ভাড়াবাড়িতে থাকা অধিকাংশ শহুরে দরিদ্রদের জন্য এটি নির্মম বাস্তবতা। সবার সঞ্চয় কমে গেছে আশ্চর্যজনকভাবে। ভিএনপি এবং দরিদ্র নয় এমন শ্রেণীর মানুষদের সঞ্চয়ের পরিমাণ কোভিড-পূর্ববর্তী অবস্থার চেয়ে নিচে নেমে গেছে। একই সঙ্গে সব শ্রেণীতেই ঋণের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়েছে।
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘যদিও করোনাকালে সামাজিক সুরক্ষা নামমাত্র (Token) ভূমিকা পালন করছে কিন্তু এটিকে অগ্রাধিকার দেয়া দরকার। শহরের দরিদ্র শ্রেণী এবং ‘নতুন দরিদ্রদের’ জন্য বর্তমানে থাকা সুরক্ষা কর্মসূচির পাশাপাশি কার্যকরী ও প্রযুক্তিভিত্তিক নতুন ও তাৎপর্যপূর্ণ আরও কর্মসূচি হাতে নেয়া উচিত।’
তিনি আরও বলেন, ‘নতুন আয়ের ধাক্কা সামলাতে ‘স্মার্ট’ লকডাউন দরকার। এটি স্বাস্থ্যগত ও অর্থনৈতিক অগ্রাধিকারও বটে।’
সবশেষে তিনি দারিদ্রের ফাঁদে পড়া নারী ও ‘নতুন দরিদ্রদের’ সহায়তার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেন। তিনি জানান, সিএসএমইসহ অর্থনৈতিক দুরবস্থায় পড়া খাতগুলোতে একটি পরিকল্পিত এবং ‘জোর ধাক্কা’ দেয়া প্রয়োজন। শুধু তাই নয় তিনি অতি দ্রুত একটি জাতীয় সিএসএমই পুনরুদ্ধার কর্মসূচি প্রণয়নেরও আহ্বান জানান।
এএসএস/ইএ/জিকেএস