ভয়ের সংস্কৃতি
বৃহস্পতিবার বসা ছিলাম দেশের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজামের কক্ষে। এমন সময় এলো ভয়ংকর সেই খবর। বগুড়ার শিবগঞ্জে শিয়া মসজিদে নামাজরত মুসুল্লিদের উপর সন্ত্রাসীদের গুলি, একজন মারা গেছে, দু’জন আহত হয়েছে।
যদি স্থানের নাম না দিয়ে এ খবরটি পড়া হয়, মনে হবে পাকিস্তানের সংবাদ পড়ছি। কিন্তু দুঃখজনক হলো একটি শক্তি দেশটিকে পাকিস্তান বা আফগানিস্তান বানাতে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। অথচ এটি এমন এক দেশে ইদানীং বারবার ঘটছে, যে দেশের মাটি কোনোদিনই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ছাড়া সংঘাতকে প্রশ্রয় দেয়নি, এখানকার সাধারণ মানুষ কখনো একে অন্যকে ধর্ম বা গোষ্ঠি দিয়ে বিচার বিবেচনা করেনি। এক ভয়ের বাতাবরণ তৈরি করা হচ্ছে। তারাই করছে, যাদের অপরাধের সাজা দেয়া শুরু হয়েছে। তারাই করছে যারা স্বাভাবিকভাবে যা ভাবতে পারে মানুষ, তার চেয়েও ভয়ংকর সব মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছিল এদেশে।
একটা ভয়ের সংস্কৃতি লালনের চেষ্টা। যারা লেখকদের হত্যা করে, যারা নামাজরত মুসুল্লিদের হত্যা করে, যারা ধর্মীয়ভাবে মানুষে মানুষের বিভেদ সৃষ্টি করে, তারা একটা বার্তা খুব দ্রুত ছড়িয়ে দিতে চাচ্ছে যে এদেশে ব্যক্তিস্বাধীনতার কোনো স্থান থাকবে না তা সে ধর্মীয় হোক, লেখালেখি হোক বা রাজনীতি হোক। সেই ১৯৭১-এ তারা একবার চেষ্টা করেছিল। শুধুই খুন খারাবি, ধর্ষণ, লুটতরাজের মাধ্যমে হিংসার বীজ ছড়িয়ে দিয়েছিল তারা।
সেবার তারা পারেনি। আবার সেই পুরোনো খেলায় তারা মেতেছে। এবার কি সফল হবে সেই শক্তি? সে সময় কিছু মানুষ ছাড়া পুরো জাতি এদের বিরুদ্ধে লড়েছিল। কিন্তু এবার তাদের সাথে আছে বিএনপি নামের এক বড় রাজনৈতিক শক্তি।
প্রায় প্রতিদিনই পত্রিকার পাতায় ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার এমন বিস্তার নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। আইন শৃংখলা বাহিনী বসে নেই, তবুও মগজ ধোলাইয়ের শিকার তরুণদের খুনি বানিয়ে পথে নামাচ্ছে ধর্ম ব্যবসায়ীরা।
প্রতিটি ধর্মে আছে কতনা শুভ কিছু করার উপদেশ। “আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক” কিংবা “সবাই সুখী হোক” কথাগুলোর মধ্যে যে সৌন্দর্য, যে ভালোবাসা তা ধর্ম থেকেই সমাজে এসেছে। কিন্তু হঠাৎ করে বিশ্বব্যাপী একটি গ্রুপ সক্রিয় হয়ে উঠলো সৌন্দর্য আর ভালোবাসার এমন বাণীকে সহিংস রুপ দিতে। মানুষের স্বাভাবিক মানবিকতাকে কেড়ে নিতে খেলাফত প্রতিষ্ঠার নামে মানবাধিকার খর্ব ও ক্ষুণ্ণ করে এমনসব নিয়ম চালু করতে মানবজাতির টুঁটি চেপে ধরেছে একটি দল।
ধর্মের এই ক্রুদ্ধ, ক্ষিপ্ত ও অতি সহিংস রুপ বিশ্বব্যাপী সব শান্তি কেড়ে নিচ্ছে। এই বর্বরতার উল্টো মুখে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল মানবজাতি। কিন্তু মুষ্ঠিমেয় কিছু পথ হারা মানুষ মানুষের পথকে ধ্বংস করে দিচ্ছে এখানে সেখানে। ধর্ম হলো প্রতিষ্ঠান। যদি তাই হয় তাহলে প্রতিষ্ঠান ভিন্নতাকে মুছে দিতে চায় এমন হিংস্র ভাবে?
প্রশাসনিকভাবে সরকার যা করার চেষ্টা করছে। সাধারণ নাগরিকেরা অনেক গভীরে যেতে চায় না, কিন্তু দেখতে চায় হিংসার প্রচারকরা জয়ী হয়নি। কিন্তু যদি সম্ভব না হয়, তা হলে আমাদের এই দেশ, আধুনিক যুগ থেকে চিরকালের মতো ছিটকে পড়বে। উদার পরিসর থেকে এমন ভাবে বিচ্যুত হবে এই দেশ যে, সেই আবহাওয়ায় আর ফেরা হবে না। কিন্তু এমন পরিস্থিতি আমরা আশা করি না কখনো।
ধর্মীয় মৌলবাদের শিকার হচ্ছেন লেখক, প্রকাশক, মসজিদের মুয়াজ্জিন থেকে শুরু করে অতি সাধারণ নাগরিক। এরা সবাই ধর্মকে ঢাল বানিয়ে নেওয়া কিছু ভীরু অশিক্ষিতের আক্রোশের বলি। ধর্ম মানুষকে আশার বাণী শোনায়, হত্যা করবে কেন? এদেশে রাজনৈতিক বিভাজনের কথা আমরা বলি। কিন্তু আসলে বিভাজন এখন সরল রেখায় এসে দাঁড়িয়েছে- মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ বনাম বিপক্ষ, মুক্তচিন্তা বনাম মৌলবাদ, কিংবা আধুনিকতা বনাম অন্ধকারের দিকে যাত্রা। ধর্ম বলে মানুষ সৃষ্টিকর্তার সন্তান, তাহলে কেন এমন হয়?
পুরোপুরি আশাহত হতে চাই না। কিন্তু কি যেন এক অজানা শংকার সামনে দাঁড়িয়ে আমরা। ভালো কথা বলার জন্য, মূল্যবোধের চর্চার জন্য, সহনশীলতার পূজারী হওয়ার জন্য আমাদের সমান্য নিরাপত্তাটুকুও যেন নেই। স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দেয়া জাতি আজ কতনা আতংকে আছে তার স্বাধীন ভূমিতে। সরকার করবে, করছে, কিন্তু প্রতিরোধতো সমাজ থেকে আসতে হবে। সেই আগুনের দেখা পাচ্ছি খুব অল্প অল্প। কিন্তু মানুষকে বড় স্বপ্ন দেখাবার ইতিহাসতো এই জাতির আছে। ইতিহাস আছে ঘুরে দাঁড়াবার। সামাজিক শক্তির চেয়ে বড় আলোড়ন আর কি থাকতে পারে?
এইচআর/এমএস