একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের টাকা হরিলুট!


প্রকাশিত: ০৯:১৩ এএম, ২৬ নভেম্বর ২০১৫

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলায় একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পে আড়াই কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। এ অভিযোগে উপজেলা সমন্বয়কারীসহ তিনজনকে ইতোমধ্যে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। টাকা জমা দিয়ে গ্রামের সাধারণ মানুষ সুবিধাভোগীর বদলে ভুক্তভোগী হয়ে গেছেন।

বিনিয়োগকারীদের টাকা ফেরত পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। গ্রামীণ জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে প্রধানমন্ত্রীর গৃহীত প্রকল্পের লক্ষ্য ব্যাহত হচ্ছে।

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার গ্রামের বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে ২০১১ সালে ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার জগন্নাথপুর, বালিয়া, বেগুনবাড়ী, নারগুণ, রাজাগাঁও, জামালপুর, বড়গাঁওসহ ২১টি ইউনিয়নে ১৮৯টি গ্রাম উন্নয়ন সমিতি রয়েছে। এসব সমিতিতে ৬০ জন করে সদস্য রয়েছেন। এ হিসেবে সদর উপজেলায় মোট সদস্য সংখ্যা ১১ হাজার ৩৪০ জন।

সমিতির হতদরিদ্র সদস্যরা মাসিক ২`শ টাকা করে কিস্তির মাধ্যমে বছরে মোট দুই হাজার ৪`শ টাকা সঞ্চয় করেন। পরবর্তী সময় নিয়মানুযায়ী ওই সদস্যের হিসাবের অনুকূলে সরকারি সমপরিমাণ টাকা জমা হওয়ার কথা। এক বছর পর থেকে প্রত্যেক সদস্যকে সঞ্চয়, সরকারি ঋণ ও প্রধানমন্ত্রীর তহবিলের টাকা মিলে সমভাবে বণ্টনের মাধ্যমে ঋণ দিতে হবে। এ নিয়মের তোয়াক্কা না করে সদস্যদের জমা টাকা থেকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়ম করা হয়েছে।

সর্বশেষ গত জুনে নবাগত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) মাধ্যমে দুই হাজার ৫১৯ জন সদস্যের ঋণ আবেদন অনুমোদন করানো হয়। নিয়মানুযায়ী আবেদন ছাপানোর পাশাপাশি সফট কপি অনলাইনে অনুমোদন করা প্রয়োজন। কিন্তু ইউএনওর অনুমোদন না নিয়ে উপজেলা সমন্বয়কারী ফাইল অনুমোদন করে সদস্যদের ঋণ প্রদানের নামে দুই কোটি ৫১ লাখ টাকা ব্যাংক থেকে উত্তোলন করেন। এর পুরো টাকা তিনি আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ।

ঋণের সফট কপি অনলাইনে প্রকাশ ও অনুমোদিত ঋণের টাকা প্রদানে তালবাহানা করলে বিষয়টি ইউএনও আশরাফুল ইসলামের সন্দেহ হয়। তিনি এ বিষয়ে তদন্ত করেন। বিষয়টি ঢাকায় প্রকল্প পরিচালককে লিখিতভাবে জানান তিনি। গত ১০ অক্টোবর সহ-পরিচালক রবীন দত্ত ও উপ-প্রকল্প পরিচালক নজির আহম্মদকে সদস্য করে দুই সদস্য বিশিষ্ট অডিট (হিসাব নিরীক্ষা) কমিটি গঠন করা হয়। গত ১৬ অক্টোবর থেকে অডিট শুরু হয়। অডিটে মোটা অঙ্কের অর্থের গড়মিল পেলে উপজেলা সমন্বয়কারী পজিরুল ইসলাম, ব্যাংক সিগনোটরি ও মাঠকর্মী সালাউদ্দীন মানিক ও পরিমল সরকারকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়।

বালিয়া সমিতির মাঠকর্মী শাহাদাত হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, বিভিন্ন সময়ে সদস্যদের কাছ থেকে উত্তোলিত ঋণের কিস্তির টাকা টিটি করে কেন্দ্রের প্রধান কার্যালয়ে পাঠানোর নিয়ম থাকলেও সমন্বয়ক তা পাঠাননি। এভাবে তিনি মোটা অঙ্কের টাকা গোপনে হাতিয়ে নেন।

ঋণের টাকা আত্মসাতের ঘটনা জানতে পেরে সদর উপজেলার একটি বাড়ি একটি খামারের বিভিন্ন গ্রাম উন্নয়ন সমিতির সদস্যরা দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির দাবি জানান। দ্রুত এ ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়বে বলে জানান তারা।

এ বিষয়ে ফিল্ড সুপারভাইজার সালাউদ্দিন মানিক জাগো নিউজকে জানান, উত্তোলন করা ঋণের টাকা সমন্বয়কারী পজিরুল ইসলামের কাছে রয়েছে। সমিতির সদস্যদের ঋণ পরিশোধের যে টাকা ব্যাংকে জমা দিতে হয় সে টাকা তিনি জমা না করে নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন। তাই এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।

তিনি আরও জানান, সমন্বয়কারী আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। তাই তিনি চেকে স্বাক্ষর করতে বললে আমরা স্বাক্ষর করি। কিন্তু এ টাকা তিনি কি করেছেন, তা তিনিই জানেন।

উপজেলা সমন্বয়কারী পজিরুল ইসলাম বলেন, সঠিক অর্থের হিসাব মিলিয়ে দিতে পারিনি বলে আমাদের বরখাস্ত করা হয়েছে। আর্থিক দুর্নীতির বিষয়ে আমরা সবাই দায়ী। যার যেখানে দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে, তারা তা সঠিকভাবে পালন করেননি। সদস্যদের কাছ থেকে টাকা মাঠকর্মীরা সংগ্রহ করে আনেন। কিন্তু টাকা প্রদান ও উত্তোলনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়। এরপর ইউএনওর অনুমোদন হয়ে টাকা এজেন্ট অ্যাকাউন্টে আসে। এরপর যৌথ স্বাক্ষরে এ টাকা উত্তোলন করা হয়। এখানে এককভাবে টাকা কখনো উত্তোলন করা সম্ভব নয়। টাকা আত্মসাতের বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। কারণ প্রকল্পের সব লেনদেনের হিসাব এখনো শেষ হয়নি।

এছাড়া বিভিন্ন সময় পজিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে কার্যালয়ে বসে মাদক সেবনের অভিযোগ উঠেছে। এ অভিযোগে তাকে বেশ কয়েকবার সতর্ক করে দেন আগের ইউএনওরা। কিন্তু এরপরও থেমে নেই নিয়মিত মাদক সেবন।

এ বিষয়ে পজিরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, আমি শখ করে বন্ধুদের সঙ্গে কয়েকবার ফেনসিডিল সেবন করেছিলাম। কিন্তু সেটা অতীতের বিষয়। চাকরি হওয়ার পরে পরিবারের চাপে এসব সেবন ছেড়ে দিয়েছি।

ঠাকুরগাঁ সদর ইউএনও মো. আশরাফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, প্রকল্পের ঋণ আবেদনের কিছু ছাপা কপি অনুমোদন নিলেও সফটকপি অনুমোদন গ্রহণে টালবাহানা করেন উপজেলা সমন্বয়কারী পজিরুল। এতে সন্দেহ হয়, তাই আমি বিষয়টি গোপনে তদন্ত করি।

তদন্তে জানা যায়, অনুমোদিত ঋণের টাকা ব্যাংক থেকে তোলা হলেও মাঠ পর্যায়ের সদস্যরা পাননি। এর পরিমাণ প্রায় দুই কোটি টাকার অধিক। এ ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

রবিউল এহসান রিপন/এমজেড/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।