পিএসসিতেই ঝরে পড়ছে দেড় লাখ শিক্ষার্থী


প্রকাশিত: ০৭:৫৯ এএম, ২৬ নভেম্বর ২০১৫

উপবৃত্তি ও স্কুল ফিডিংসহ সরকারি বেসরকারি নানা উদ্যোগের পরও প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি সমাপনী পরীক্ষায় (পিএসসি) অনুপস্থিতির সংখ্যা কমছে না। প্রতি বছর পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য নিবন্ধন করেও প্রায় দেড় লাখ শিক্ষার্থী অনুপস্থিত থাকছে। এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর অনুপস্থিতির জন্য দারিদ্র্য ও ভুয়া ভর্তিকে দায়ি করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর সূত্র জানায়, এবার পিএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য ৩২ লাখ ৫৪ হাজার ৫১৪ জন পরীক্ষার্থী নিবন্ধন করে। গত ২২ নভেম্বর প্রথম দিন ইংরেজি বিষয়ে এক লাখ ৪৯ হাজার ৮৯৬ জন পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল। এর মধ্যে প্রাথমিকে ২৯ লাখ ৪৯ হাজার ৬৩ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে অনুপস্থিত ছিল এক লাখ আট হাজার ৪২১ জন। শতকরা হিসেবে এ হার তিন দশমিক ৬৭ ভাগ। ইবতেদায়িতে ৩ লাখ ৫ হাজার ৪৫১ জনের মধ্যে ৪১ হাজার ৪৭৫ জন অনুপস্থিত ছিল। শতকরা হিসেবে এ হার ১৩ দশমিক ৫৫ ভাগ। দ্বিতীয় দিনের পরীক্ষায় অনুপস্থিতির সংখ্যা আরো এক হাজার ৬১৩ জন বেড়েছে।

এর আগে ২০১৪ সালে এক লাখ ৪৩ হাজার ৪৪০ জন পরীক্ষার্থী অংশ নেয়নি। ২০১৩ সালেও প্রায় দেড় লাখ পরীক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল। শুধু এই তিন বছরই নয় ২০০৯ সালে পিএসসি পরীক্ষা চালুর পর থেকে প্রতি বছরই বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী নিবন্ধন করেও পরীক্ষায় অনুপস্থিত থাকছে।

প্রাথমিক অধিদফতর পরিচালিত ২০১৪ সালের বার্ষিক প্রাথমিক বিদ্যালয় শুমারি প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, পঞ্চম শ্রেণিতে ২ দশমিক ৩ ভাগ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। এর প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে দারিদ্র্যতা এবং ভুয়া ভর্তিকে। দারিদ্র্যের কারণে অনেকে লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে কাজে করছে। আবার কেউ বাড়িতে অলস সময় কাটায়। অনেকেই বাবা-মায়ের সঙ্গে গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি দেয়। অপরদিকে যে সংখ্যক শিক্ষার্থী অনুপস্থিত দেখানো হচ্ছে, তারা আসলে শিক্ষার্থীই নয়। শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়তি দেখানোর জন্য স্কুলগুলোতে ভুয়া ভর্তি দেখানো হয়। ফলে পরীক্ষায় অনুপস্থিতির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্রাকের শিক্ষা প্রকল্পের ব্যবস্থাপক বিএ ওয়ালিদ নিউটন জাগো নিউজকে বলেন, পরীক্ষায় অনুপস্থিতির বিষয়টি আসলে ঝরে পড়া। এর সঙ্গে বেশ কয়েকটি বিষয় জড়িয়ে আছে। ঝরে পড়ার মূল বিষয়টি হচ্ছে- পাঠক্রম শেষ করতে শিক্ষার্থীদের কিছুটা প্রতিবন্ধকতার তৈরি হয়। এই প্রতিবন্ধকার জন্য তারা যথাসময়ে সিলেবাস শেষ করতে না পেরে পরীক্ষায় অনুপস্থিত থাকে। অনেক বিদ্যালয়ে শিক্ষার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ না থাকাকেও দায়ি করেন তিনি।

ওয়ালিদ নিউটন বলেন, অনুপস্থিতির সংখ্যা কমিয়ে আনতে স্কুল ও শিক্ষকদের শিক্ষার্থীবান্ধব করতে হবে। আর শিক্ষার্থীদের যে পরীক্ষা ভীতি আছে তা দূর করতে কিছু উদ্যোগ নিতে হবে। পরীক্ষায় যোগ্যতাভিত্তিক প্রশ্ন প্রণয়ন করা হয়েছে এটা সরকারের একটি ভাল উদ্যোগ। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে এই আইডিয়াটা যথাযথভাবে নেই। এ বিষয়ে অনেক দুর্বলতা আছে। এসব সমস্যার সমাধান করলে অনুপস্থিতির হার কমে আসবে বলে তিনি আশা করেন।

সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত বাংলাদেশের শিক্ষার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পঞ্চম শ্রেণির বাংলায় ও গণিতে যথাক্রমে ৭৫ ও ৬৭ শতাংশ শিশু ভালোভাবে শিখছে না। যেসব শিক্ষার্থীর শেখার মাত্রা খারাপ তাদের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ না করেই ঝরে পড়ার ঝুঁকি বেশি। ঝরে পড়ার পর একপর্যায়ে তারা অনানুষ্ঠানিক কর্মবাজারে প্রবেশ করে।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, দারিদ্রতা, দুর্বল শিখন পদ্ধতি, অদক্ষ শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের দুর্বল ভিত্তি, বাল্যবিবাহ, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব, চাহিদার তুলনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংকট, ত্রুটিপূর্ণ পরীক্ষা পদ্ধতি, কুসংস্কার, লেখাপড়ার খরচ বিশেষ করে প্রাইভেট- কোচিং খরচ চালাতে না পারা, উপার্জনে নেমে পড়া, শিক্ষার গুণগত মানের ঘাটতির কারণে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে। ঝরে পড়া রোধে প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের আরো বেশি সময় স্কুলে ধরে রাখার ওপর জোর দিতে বলা হয়েছে। প্রণোদনা সৃষ্টির মাধ্যমে প্রতিটি শিশু যাতে শিক্ষণের আওতায় এসে তার জন্য একটি মজবুত ভিত গড়ে তোলার জন্য উদ্যোগ ও দক্ষতা বাড়ানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

দুর্গম এলাকায় প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার আরো বেশি। ২৪ নভেম্বর নভেম্বর ব্রাক ‘দুর্গম এলাকায় প্রাথমিক শিক্ষার প্রতিবন্ধকতা’ বিষয়ে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, হাওর-বাওড় এলাকায় পঞ্চম শ্রেণিতে ঝরে পড়ার হার ১৯ দশমিক ৫ শতাংশ।

ঝরে পড়ার প্রধান কারণ হিসেবে বলা হয়েছে- গৃহকাজের জন্য ৮ দশমিক ৬ শতাংশ, পারিবারিক কাজে বাবা-মাকে সহায়তায় ১০ দশমিক ৯ শতাংশ, পড়ালেখা করতে না চাওয়ার জন্য ১২ দশমিক ১ শতাংশ, কাজের জন্য ১২ দশমিক ১ শতাংশ, স্কুলের প্রতি আকর্ষণ না থাকায় ১২ দশমিক ৯ শতাংশ, কাজ করে আয়ের জন্য ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ, অসচেতনতায় ২১ দশমিক ৯ এবং শিক্ষা ব্যয়নির্বাহ করতে না পারার কারণে ৮০ দশমিক ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। এছাড়া পুষ্টিহীনতাকেও ঝরে পড়ার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. আলমগীর বলেন, আমরা চাই সব শিশু প্রত্যাশিত যোগ্যতা অর্জন করুক। এ জন্য ৮২টি উপজেলার বিভিন্ন স্কুলে দুপুরে উন্নত মানের বিস্কুট অথবা রান্না করা খাবার দেয়া হচ্ছে। আগামী বছর প্রাথমিকের সকল শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি দেয়া হবে। এধরনের প্রচেষ্টার মাধ্যমে ধীরে ধীরে অনুপস্থিত হার কমে যাবে।

এনএম/এসআইএস/এআরএস/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।