মৃত স্ত্রীকে দুর্ঘটনায় নিহত দাবি: স্বামীসহ শ্বশুর-শাশুড়ি গ্রেফতার

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১১:১৬ এএম, ০৪ এপ্রিল ২০২১

রাজধানীর হাতিরঝিলে প্রাইভেটকার দুর্ঘটনায় শনিবার (৩ এপ্রিল) ঝিলিক আলম (২৩) নামে এক নারীর রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় ঝিলিককে হত্যার অভিযোগ এনে গুলশান থানায় মামলা করেছেন তার মা তহমিনা হোসেন আসমা। মামলার আসামিরা হলেন- নিহত ঝিলিকের স্বামী সাকিব আলম মিশু, দেবর ফাহিম আলম, শাশুড়ি সায়িদা আলম, শ্বশুর জাহাঙ্গীর আলম এবং বাসার ম্যানেজার আশিশ।

জানা গেছে, ২০১৮ সালের প্রথমদিকে সাকিব আলম মিশুর সঙ্গে ফেসবুকে পরিচয় হয় নিহত ঝিলিক আলমের (২৩)। পরে প্রেমের সম্পর্কে জড়ায় তারা। মিশু বাবা-মায়ের কাছে পছন্দের বিষয়টি জানালে তারা ঝিলিকের পরিবার সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিয়ে বিয়েতে অমত দেন। কারণ, ঝিলিক নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। তার বাবা একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করতেন। সাকিব আলম মিশুর পরিবার গুলশান-২ এর স্থায়ী বাসিন্দা। আর ঝিলিকের পরিবার মোহাম্মদপুরের তাজমহল এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন। তাই আর্থিকভাবে সচ্ছল হওয়ায় সাকিবের পরিবার গরিব পরিবারের মেয়ের সঙ্গে ছেলের বিয়ে মেনে নিতে পারেনি। সাকিব তাকে ছাড়া অন্য মেয়েকে বিয়ে করবেন না বলে জানিয়ে দেন তার পরিবারকে। একপর্যায়ে ছেলের জেদের কাছে হার মানেন তারা। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে পারিবারিকভাবেই বিয়ে হয় তাদের। বিয়ের পর মিশুদের বাড়িতেই ওঠেন ঝিলিক। কয়েক মাস তারা ভালোই ছিলেন। ২০২০ সালের শুরুর দিক থেকে শুরু হয় অশান্তি।

পুলিশ বলছে, এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত গ্রেফতার আছেন তিনজন। তারা হলেন- ঝিলিকের স্বামী সাকিব আলম মিশু, শ্বশুর জাহাঙ্গীর আলম ও শাশুড়ি সায়িদা আলম।

ঝিলিকের মা তহমিনা হোসেন আসমা অভিযোগ করে বলেন, ‘বিয়ের পর মিশুর বাবা-মা ও ভাইবোন নির্যাতন শুরু করেন। উঠতে-বসতে তারা ঝিলিককে ‘গরিবের মেয়ে’ বলে গালমন্দ করতেন। নির্যাতনও করা হতো।’

গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় গুলশান থানায় মামলা করতে এসে এসব কথা বলার সময় অঝরে কাঁদছিলেন বৃদ্ধা তহমিনা। চোখ মুছতে মুছতে বলেন, ‘আমরা গরিব। বিয়ের পরপর দু-একবার গিয়েছি ঝিলিকের শ্বশুরবাড়ি। কিন্তু তার শ্বশুর-শাশুড়ি ও দেবর খারাপ আচরণ করতেন। কেন ওই বাসায় পা রেখেছি- এটা শুনিয়ে আজেবাজে কথা বলতেন তারা। এ আচরণে তাদের বাড়ি আর যাইনি আমরা।’

ঝিলিকের মা আরও জানান, ২০১৯ সালের জুনে ঝিলিককে মারধর করে বাসা থেকে বের করে দেয়া হয়। তিনি একাই তাজমহল রোডে বাবা-মায়ের বাসায় ওঠেন। কয়েকদিন পর মিশু যান সেখানে। প্রায় দেড় মাস থাকেন তাদের বাসায়। এরই মধ্যে বিভিন্ন সময় মিশুর মা তাকে ফোন করে বাসায় চলে আসতে বলতেন। আগস্টের শুরুর দিকে মিশুকে জোর করে গুলশানের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। তখন খিলগাঁওয়ের একটি মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে রাখা হয় তাকে। কয়েকদিন স্বামীর ফোনে সাড়া না পেয়ে ঝিলিক গুলশানে শ্বশুরবাড়িতে যান। কিন্তু শাশুড়ি তাকে বাসায় ঢুকতে দেননি। ফিরে যান বাবার বাসায়। কয়েক দিন পর আবার গুলশানে যান। সেদিনও বাসায় ঢুকতে দেয়া হয়নি।

তহমিনার অভিযোগ, তার মেয়েকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবি জানান তিনি।

গতকাল শনিবার ঘটনার পর সাকিব প্রথমে সাংবাদিকদের কাছে বলেন, ‘সকালে গুলশানের ৩৬ নম্বর সড়কের বাসা থেকে বের হলে চাকা ফেটে গাড়ি ফুটপাতে উঠে যায়। এরপর সে (ঝিলিক) মারা যায়।’ ঝিলিকের শরীরে দুর্ঘটনার আঘাতের চিহ্ন নেই, কীভাবে মারা গেলেন? জানতে চাইলে তিনি রেগে গিয়ে বলেন, ‘আমি কি জানি।’ এরপর তিনি উপস্থিত কারো কোনো প্রশ্নের উত্তর দেননি। এ সময় তিনি মিরপুরের এমপি মো. ইলিয়াস মোল্লা তার নানা বলে জানান।

হাতিরঝিল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. মহিউদ্দিন বলেন, ‘জিজ্ঞাসাবাদে সাকিব দাবি করেন তিনি স্ত্রীকে ডাক্তার দেখাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিলেন। পথে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললে তার স্ত্রী গুরুতর আহত হন এবং তিনিও আহত হন। তার হাতে ব্যান্ডেজ আছে। ঘটনাটি রহস্যজনক মনে হওয়ায় গুলশান থানার সহায়তায় বাড়িতে খোঁজ নেয়া হয়। জানা যায়, গুলশান থেকে মৃত অবস্থায়ই ঝিলিককে হাসপাতালে নেয়া হচ্ছিল। সাকিব ঘটনাটি আড়াল করছেন। ঘটনাস্থল গুলশান থানা এলাকায় হওয়ায় তারাই আইনগত ব্যবস্থা নেবে।’

পুলিশ সূত্রে জানা যায়, শনিবার দুপুর ১২টার দিকে পুলিশ ৩৬ নম্বর সড়কের ২৩/সি নম্বর বাড়িতে তল্লাশি চালায়। এ সময় তার ছোট ভাই ফাহিমসহ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। বাড়ির সিসি ক্যামেরার ফুটেজ জব্দ করেছে পুলিশ। সেখানে দেখা যায়, সকাল ৯টা ৯ মিনিটের দিকে দুই নারী ও দুই পুরুষ নিথর অবস্থায় ঝিলিককে সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে গাড়িতে তুলছেন। তখন পেছন পেছন হেঁটে যান সাকিব।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দায়িত্বরত চিকিৎসকের বরাত দিয়ে ঢামেক পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া জানান, হাতিরঝিলে ডিভাইডারে ধাক্কা লাগার পর প্রাইভেট কার থেকে উদ্ধার করা নারীর মৃত্যু সড়ক দুর্ঘটনায় নয়, তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করছেন চিকিৎসক।

চিকিৎসকের বরাত দিয়ে বাচ্চু মিয়া জানিয়েছেন, ওই নারীর পা, মাথা ও গলায় আঘাতের চিহ্ন আছে। বালিশচাপা দিয়ে হত্যা করা হলে যে ধরনের লক্ষণ দেখা যায়, এখানেও সে ধরনের লক্ষণ আছে।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা গুলশান থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ফেরদৌস আলম সরকার জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত নিহতের স্বামীসহ তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতার অন্যরা হলেন- নিহতের শ্বশুর জাহাঙ্গীর আলম ও শাশুড়ি সায়িদা আলম।

গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘গতকাল শনিবার নিহতের মা বাদী হয়ে পাঁচজনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেছেন। হাতিরঝিল থানা থেকে নিহতের স্বামী সাকিব আলম মিশুকে আমাদের থানায় আনা হয়েছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। পাশাপাশি তার মা-বাবা এ মামলার আসামি হওয়ায় তাদেরকেও গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। বাড়ির সিসি ক্যামেরার ফুটেজ জব্দ করা হয়েছে। ঘটনাটি তদন্তের বিষয়, তদন্ত শেষে বিস্তারিত জানাতে পারবো।’

টিটি/ইএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।