স্মৃতিসৌধের স্থপতি মাইনুল আর নেই
জাতীয় স্মৃতিসৌধ তৈরির স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন আর নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। সোমবার দুপুরে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। তার বয়স হয়েছিল ৫২ বছর।
হাসপাতালের পরিচালক আবদুল্লাহ আল শাফি মজুমদার এর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন।
১৯৫২ সালের ৫ মে মুন্সীগঞ্জ জেলার টঙ্গীবাড়ীর দামপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করে মাইনুল হোসেন। তার বাবা মুজিবুল হক ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে ইতিহাস পড়াতেন। ছেলেবেলায় মইনুল চেয়েছিলেন প্রকৌশল বিষয়ে পড়তে। ঢাকা তখন গণঅভ্যুত্থানে উত্তপ্ত। ওই সময় মইনুলকে ফরিদপুর থেকে ঢাকায় পাঠানো হয়। ১৯৭০ সালে তিনি ভর্তি হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্যবিদ্যা বিভাগে।
১৯৭১ সালে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস বন্ধ হয়ে যায়। মইনুল মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ীর দামপাড়া গ্রামে আশ্রয় নেন। খুব কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধকে অনুভব করেন তিনি। ১৬ ডিসেম্বরের পর ফিরে আসেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সোহরাওয়ার্দী ছাত্রাবাসে।
১৯৭৬ সালে মইনুল প্রথম শ্রেণীতে স্থাপত্যবিদ্যায় স্নাতক হন। ১৯৭৬ সালের এপ্রিল মাসে EAH Consultant Ltd-এ জুনিয়র স্থপতি হিসাবে যোগ দেন। কয়েক মাস পর চাকরি ছেড়ে ওই বছরের আগস্টে যোগ দেন ‘বাংলাদেশ কনসালট্যান্ট লিমিটেড’-এ। তার কর্মজীবন বেশ বৈচিত্র্যময়।
১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ সরকারের গণপূর্ত বিভাগ মুক্তিযুদ্ধের ত্রিশ লাখ শহীদের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এরপর নকশা আহবান করা হয়। তখন ২৬ বছরের তরুণ স্থপতি মইনুল স্মৃতিসৌধের নকশা জমা দেন।
মোট ৫৭ জন প্রতিযোগী স্মৃতিসৌধের ডিজাইন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন এবং তার মধ্যে স্থপতি মইনুল হোসেনের ডিজাইনটি শ্রেষ্ঠ বিবেচিত হয়। নিচের মূল ভিত্তি থেকে ওপরের দিকে উঠে-যাওয়া সাতটি দেয়ালসদৃশ ত্রিকোণ কলাম। কলামগুলো বিভিন্ন উচ্চতার ও আলাদা-আলাদাভাবে পাশাপাশি ওপরের দিকে উঠে গেছে, যার সবচেয়ে উঁচু কলামটি ১৫০ ফুট। বিভিন্ন দিক থেকে এটি ভিন্ন ভিন্ন আকারে দৃশ্যমান হয়। সামনের দিক থেকে দেখলে মনে হবে -যেন একক-শুভ্র এক শৈল্পিক স্থাপনা আকাশ স্পর্শ করার জন্য মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে গর্বিত ভঙ্গিমায়; সামনের লেকের পানিতে তার ছায়া এক অপূর্ব দৃশ্য তৈরি করেছে। আবার পাশ থেকে দেখলে মনে হয়, আকাশে ডানা মেলে-দেয়া একঝাঁক শুভ্র-বলাকা যেন! বিজয়ের আনন্দে উদ্ভাসিত সমগ্র বাংলাদেশের প্রতিভূ জাতীয় স্মৃতিসৌধ।
১৯৭৬ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত সৈয়দ মইনুল হোসেন ৩৮টি বড় বড় স্থাপনার নকশা করেন। এর মধ্যে জাতীয় স্মৃতিসৌধ, IRDP ভবন কাওরানবাজার, ভোকেশনাল টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ও ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ বার কাউন্সিল ভবন, চট্টগ্রাম ইপিজেড, বাংলাদেশ চামড়াজাত প্রযুক্তির কর্মশালা ভবন, উত্তরা মডেল টাউন, বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার খাদ্য গুদামের নকশা, কফিল উদ্দিন প্লাজা, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস ভবন, ঢাকা শহরের বিভিন্ন বেসরকারি আবাসন প্রকল্পের নকশা করেছেন তিনি।