বন্ধুত্ব সম্ভব কী?
“বন্ধুর সাথে মিলন ভাগ্যে ছিল না। যদি আরও বাঁচতাম এই প্রতিক্ষাই চলতো।” - মির্জা গালিব
“কার মিলন চাও বিরহী? তাহারে কোথা খুঁজিছ?” - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বন্ধুত্ব নিয়ে অ্যারিস্টটল থেকে শুরু করে জাক দেরিদা অবধি ভেবেছেন। বন্ধুত্ব নিয়ে দার্শনিকরা এতটা ভেবেছেন তার কারণ পারিবারিক মাতৃত্ব, সন্তানত্ব, ভ্রাতৃত্ব, পতিপত্নীত্ব ইত্যাদি সম্পর্কের মতো এই সম্পর্কটি কোনো নৈসর্গিক বা সামাজিক দায়িত্ব-কর্তব্য, অনির্বাচিত বন্ধনের দ্বারা আবদ্ধ নয়। এ হল এক স্বাতন্ত্র্যময়, পরস্পরের নিরপেক্ষতাময়, স্বেচ্ছানির্বাচিত বন্ধনহীন গ্রন্থী। কিন্তু দার্শনিকরা বন্ধুত্ব সম্ভব নয়- বলেই তাঁদের মতামত দিয়েছেন।
অ্যারিস্টটল বন্ধুত্বকে জীবনের জন্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। তিনি মনে করতেন বন্ধুত্ব ছাড়া মানব জীবন চলতে পারে না। তিনি তিন রকমের বন্ধুত্বের কথা বলেছেন- ১.দরকারের বা স্বার্থের বন্ধুত্ব (Friendship of Utility); ২. সুখের বা শখের বন্ধুত্ব ( Friendship of Pleasure); ৩. চরিত্র্যগুনের সদভাবের বন্ধুত্ব ( Friendship of Virtue)। এরমধ্যে তৃতীয় প্রকারের বন্ধুত্বকে অ্যারিস্টটল সবচেয়ে উন্নতমানের বন্ধুত্ব বলে মনে করতেন। উন্নত চরিত্রের দু’জন মানুষের মধ্যেই কেবলমাত্র এরূপ বন্ধুত্ব হতে পারে বলে তিনি মনে করতেন। এই ধরনের বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে সম-মানসিকতা, একে অন্যের প্রতি প্রগাঢ় ভালবাসা বন্ধুত্বের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। অ্যারিস্টটল মনে করতেন বন্ধুত্ব যখন এই স্তরে পৌঁছায় তখন সেখানে ন্যায়পরায়নতার মত বিষয় নিয়ে আলাদাভাবে ভাবার দরকার হয় না।
দার্শনিক কান্ট মনে করতেন- বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে পুরোপুরি দু-জন দু-জনকে জেনে গেলে কোনো দূরত্ব, কোনো রহস্য, বা কোনো বিস্ময়বোধ থাকবে না- এই ভীতি শুধু স্বাভাবিক নয়, যুক্তিযুক্তও বটে। কারণ একটু অজানার ব্যবধান ছাড়া অপরের প্রতি সেই সশ্রদ্ধ সম্ভ্রমবোধ থাকে না, যা ছাড়া বন্ধুত্ব টেকে না। আদর্শ বন্ধুত্ব তাই যুগপৎ এক পারস্পরিক উন্মোচন ও অবগুণ্ঠনের দাবি করে বলেই, কান্ট প্রাচীন গ্রীক ও রোমান মুনিদের দোহাই দিয়ে মারিয়া ফন হার্বাটকে লিখেছিলেন যে, এ জগতে প্রকৃত সখ্য সম্ভবই নয়। নব্বই এর দশকে দার্শনিক জাক দেরিদা ‘Politics of Friendship’ নামে একটি বিশ্লেষণী গ্রন্থ রচনা করেন, যেখানে তিনি বলেন, “প্রিয় বন্ধুগণ! কেউ কারুর বন্ধু নয়”।
কেন বন্ধুত্ব সম্ভব নয়? কয়েকটি বিষয় পরীক্ষা করা যাক:
ক. সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ পাল্টায়। দুটি পরস্পর নিরপেক্ষ, অনিয়মিতভাবে পরিবর্তমান সম্পর্কের মধ্যে কোনো অপরিবর্তনীয় সম্পর্ক সম্ভব কি? যেকোনো পরিচিতি বা সহাবস্থান বা অচিরস্থায়ী মোহই তো আর সখ্য নয়! বাস্তবে কর্তব্যমাত্রসার একঘেয়েমি অথবা অস্থায়ী উচ্ছ্বসিত অনুরাগ দোটানায় পড়ে অনিত্য দুটি চরিত্রের মধ্যে নিত্য এক বন্ধুত্ব নিতান্তই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।
খ. অপর ব্যক্তি হয় আমার প্রয়োজনে লাগে অথবা লাগে না। যদি সে আমার প্রয়োজনে লাগে অর্থাৎ তাকে আমি কোনো স্বার্থসিদ্ধির উপায় হিসেবে ব্যবহার করি- এমনকি নিছক একাকিত্বমোচন অথবা ভাববিনিময়ও যদি সেই প্রয়োজন হয়- তাহলে সে বন্ধু নয়, কারণ ব্যবহার্য বা ব্যবহৃত মানুষ তো আর বন্ধু হতে পারে না। আর যদি সে অদরকারী হয় তাহলে আমার জীবনে সে অবান্তর-তাকে ছাড়াও আমার দিব্যি চলে যায়। তবে তো সে আমার বন্ধু নয়। এ ছাড়া আর তৃতীয় কোনো সম্ভাবনা নেই।
গ.এখন যদি অমুক তার রূপ, গুণ, বিদ্যা, রসবোধ, দয়ামায়া ইত্যাদি কোন বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কারণে আমার বন্ধু হয় তাহলে আমার আসল টান ওই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের উপর- নিছক অমুকের উপর নয়। যদি অমুক সেই বৈশিষ্ট্যটি হারায়, বা নষ্ট হয়ে যায়, অথবা তমুকের যদি অমুকের থেকেও অধিকতর মাত্রায় ওইসব বৈশিষ্ট্য থাকে এবং তমুকের সাথে বন্ধুত্বের সুযোগ সৃষ্টি হয়, তাহলেই অমুক আর বন্ধু নাও থাকতে পারে। ঘ.আর একটা হতে পারে অহেতুক, বা অন্ধ ভালবাসা/বন্ধুত্ব; কিন্তু তা অহেতুক, অন্ধ বলেই অন্ধ বন্ধুত্বকে বন্ধুত্ব বলা যায় না।
ঙ.তাছাড়া বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে যতই নির্ভরশীলতা বাড়ে, যতই তাকে ছাড়া থাকা আমি সহ্য করতে পারি না, ততই আমার স্বাতন্ত্র্যহরণকারী এই বন্ধুকে সহ্য করাও কঠিন হয়ে পড়ে, সেই জন্যেও বন্ধুত্ব অসম্ভব।
বন্ধুত্ব সম্ভব নয় বলেই কি ধর্মীয় আখ্যানেও তাই নেই বন্ধুর ধারণা-আছে স্রষ্টা ও সৃষ্টি, মানুষ মানুষের ভাই। তাই বন্ধুত্ব সম্ভব নয় বলেই কি সুফিরা সংগঠিত ধর্মের বাইরে গিয়ে সমাজের নিয়মে অনিগড়িত থেকে সখ্য রসের আস্বাদন করতে চেয়েছেন? বাউল/ফকিররা মনের মানুষ খুঁজেছেন? সাম্যবাদীরা কমরেড হতে চেয়েছেন? তাই কি কবি ‘পথ বেঁধে ছিল বন্ধনহীন গ্রন্থী’ বলে এক স্বাতন্ত্র্যবিলাসী সম্বন্ধের কথা ভেবেছেন?
লেখক : জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, গবেষক
এইচআর/এমএস