‘অচ্ছুত’ জীবনে আশ্রয়ণের আলো
অচ্ছুত জীবন। বাবা-মা, ভাই-বোন, পরিবার-পরিজন, পাড়াপড়শি এমনকি সমাজেও ঠাঁই নেই। সবাই অপয়া ভেবে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। বেঁচে থাকার-ই যেন অধিকার নেই।
জীবন ধারণের তাগিদে বাজার থেকে সবজি তোলা, দোকান থেকে ৫-১০ টাকা নেয়া, বিয়ে বাড়িতে নেচে-গেয়ে কিছু টাকা নেয়া- এভাবেই পেট চলে। তাতেও আপত্তি অনেকের। বেঁচে থাকাই যেন বিষাদময়।
এটা কি মানুষের জীবন? হ্যাঁ, বাংলাদেশে তৃতীয় লিঙ্গের (হিজড়া) জীবনের চিত্র এমনই। তারা মানুষ, তাদেরও যে অধিকার আছে; এমনটা পরিবার ও সমাজ কারোরই দৃষ্টিতে নেই।
তবে এই অভাগিদের ভাগ্য বদলে এগিয়ে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার মানবিক উদ্যোগে জীবন পেয়েছেন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। মুজিববর্ষে তাদের পাকা ঘর ও কর্মসংস্থানের সুযোগ দিয়েছেন শেখ হাসিনা।
সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া হাটিকুমরুল (তৃতীয় লিঙ্গের) আশ্রয়ণ প্রকল্প ঘুরে দেখা যায়, তৃতীয় লিঙ্গের ২০ জনকে পুনর্বাসন করা হয়েছে সেখানে। জমির মালিকানাসহ পাকা ঘর, গবাদি পশু ও উপার্জনের জন্য সেলাই মেশিন দেয়া হয়েছে। সেলাই মেশিন ও গবাদি পশু পালন প্রশিক্ষণও দেয়া হয়েছে।
সেখানে গানে গানে হাসি-আনন্দে সময় পার করছেন হিজড়ারা। কেউ ছাগল, হাঁস-মুরগি ও কবুতর পালন করছেন। কেউ শাক-সবজি চাষ করছেন। কেউ আবার রান্না করছেন। এ যেন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন হিজড়ারা।
পুনর্বাসিত হিজড়ারা এ প্রতিবেদককে তাদের জীবনের নানা দুঃখ দুর্দশার কথা জানান। বাবা-মা, পরিবার ও সমাজের গঞ্জনার ইতিহাস বলেন। বলেন, মানুষের অবহেলা, তাড়িয়ে দেয়া ও নির্যাতনের জন্য নিজেদের জীবনের ওপর বিতৃষ্ণা চলে আসার কথা।
বাঁচার ইচ্ছে হতো না। তবে এখন অনেক ভালো আছেন। নতুন জীবন পেয়েছেন। নতুন করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন জেগেছে। এটি মূলত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কারণে। তিনি তাদের মমতায় জড়িয়ে নিয়েছেন।
গঙ্গা নামের এক হিজড়া জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের বাপ-মা, পরিবার ও সমাজের লোক যেটুকু ভালো না বাসত, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভালোবাসেন। সন্তানের মতো কোলে তুলে নিয়েছেন। তাকে স্যাল্যুট জানাই। দোয়া করি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দীর্ঘজীবী হোন। ঘরে ঘরে আমাদের মতো অসহায়ের সহায় হোন।
সোনিয়া নামের এক হিজড়া বলেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পের এ ঘরে আসার পরও আশপাশের মানুষ প্রথমদিকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতো। আমাদের এখানে জায়গা দেয়ায় ক্ষুব্ধ হয়েছে। পরে ধীরে ধীরে এখন তারা আসে। মেশে। কথা বলে। সুখ-দুঃখ শেয়ার করে।
এভাবেই তারা সাধারণ মানুষের মতো স্বাভাবিক জীবনে ফিরছেন। মানুষেরও তাদের ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণা পাল্টে ইতিবাচক হচ্ছে।
স্থানীয় শামীম আহমদ জাগো নিউজকে বলেন, আসলে আমরা প্রথমদিকে ভেবেছিলাম, তারা হয়তো সামাজিক পরিবেশ নষ্ট করবে। আমাদের ক্ষতি হবে। এখন তো দেখি তারা গ্রামের মানুষের মতো স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে। গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি পালন ও শাক-সবজি চাষে ব্যস্ত। তারা কাউকে বিরক্ত করে না। এখন গ্রামের মানুষ তাদের সঙ্গে মেশে, তারাও মানুষের সঙ্গে মেশে।
হিজড়াদের নেত্রী মায়া জানান, সরকারি হিসেবে তাদের ২০ জনকে জমি ও ঘর দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারা থাকছেন ৫০ জন। তারা স্বাভাবিক জীবন পেয়ে খুশি।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মাহবুব হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, আমরা সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুলে ২০ জন ও দিনাজপুর সদরের বাঙ্গি বেচা ব্রিজ এলাকায় ১২৫ জন হিজড়াকে পুনর্বাসন করেছি। পর্যায়ক্রমে সারাদেশে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের পুনর্বাসন করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা, ‘কেউ গৃহহীন থাকবে না’, এটি বাস্তবায়ন করা হবে।
তিনি বলেন, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের মৌলিক চাহিদা পূরণের পাশাপাশি তাদের কর্মসংস্থানের জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে এনে জীবন মান উন্নত করার সব ব্যবস্থা করা হবে। এটিই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্ন ও চাওয়া।
২০১৪ সালের ২৬ জানুয়ারি হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি দেন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার। সরকারের হিসাব অনুযায়ী, সারাদেশে ১১ হাজার হিজড়া রয়েছে। তাদের পুনর্বাসনের কাজ চলমান। এছাড়া সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় হিজড়াদের উপবৃত্তি প্রদান, অক্ষম ও অসচ্ছল হিজড়াদের বয়স্ক ভাতা প্রদান, দক্ষতা বৃদ্ধি ও আয়বর্ধনমূলক কাজের প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা এবং পরিবার-সমাজে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধির নানা কর্মসূচি পালন করছে।
উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় সারাদেশে ৭০ হাজার গৃহহীন পরিবারকে জমির মালিকানাসহ পাকা ঘর করে দেয়া হয়েছে। পর্যায়ক্রমে ৯ লাখ মানুষকে এই সুবিধা দেয়া হবে।
এসইউজে/এমআরআর/জিকেএস