স্বামীর ছোড়া এসিডে ঝলসে গেছে নাক, মুখে নিতে হয় নিঃশ্বাস

আলী ইউনুস হৃদয়
আলী ইউনুস হৃদয় আলী ইউনুস হৃদয় সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ থেকে ফিরে
প্রকাশিত: ০৩:৫১ পিএম, ২০ জানুয়ারি ২০২১

সামাজিক নিরাপত্তা আর দরিদ্রতার ভয় থেকে মেয়েকে ১৬ বছর বয়সেই বিয়ে দেন তার বাবা-মা। বিয়ের পর জামাইকে ধাপে ধাপে নগদ ৫০ হাজার টাকাসহ লক্ষাধিক টাকার আসবাবপত্র ও স্বর্ণ দেন। তারপরও জামাই বিভিন্ন প্রয়োজনের কথা বলে মাঝে মাঝে টাকা চেয়ে বসতেন। সেই আবদার মেটাতে বাড়ির গাছ বিক্রি করেও টাকা দিয়েছেন।

বিয়ে হওয়ার পর দেড় বছর ধরে মেয়েটি বাবা-মার পরিবারেই ছিলেন। তিনি পড়াশোনা করতেন আর মাঝে জামাই আসা-যাওয়া করতেন। বলছিলাম স্বামীর ছোড়া এসিডে আহত সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলার এক তরুণীর কথা।

ভুক্তভোগীর পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় দুই বছর আগে ২০১৮ সালের অক্টোবরে পারিবারিকভাবে একই উপজেলার মধুপুর গ্রামের কাঠ ব্যবসায়ী আব্দুল মোতালেব হোসেনের সঙ্গে মেয়েটির বিয়ে হয়। তখন সে ঝুরঝুরি লক্ষ্মীপুর মহিলা দাখিল মাদরাসায় অষ্টম শ্রেণিতে পড়ত। এ বছর তার ১৮ বছর হয়েছে। বিয়ের দেড় বছর পর গত বছরের ২৪ মার্চ শানু স্বামীর পরিবারে যান। স্বামীর বাড়িতে যাওয়ার পর ২৬ মার্চ বাবার বাড়ি থেকে টাকা আনা নিয়ে পরিবারে ঝগড়া লাগে। এ সময় তার স্বামী মোতালেব হোসেন টাকা এনে দেয়ার জন্য বলেন। না হলে বাড়িতে রাখবেন না বলেও জানান।

মেয়েটি টাকা আনার কথা এড়িয়ে যান এবং স্বামীকে বলেন, আমার সঙ্গে তো আপনার টাকা নিয়ে কোনো কথা হয়নি। কথা হলে আমার বাবা-মার সঙ্গে হতে পারে। আমি বাড়িতে টাকার কথা বলতে পারবো না। পারলে আপনি আমার বাবা-মাকে গিয়ে বলেন।

এরপর রাত হলে ভুক্তভোগীকে তার স্বামী ঘুমাতে যেতে বলেন। স্ত্রী ঘুমিয়ে পড়লে ভোরের দিকে স্বামী মোতালেব বিছানা থেকে উঠে যান। পরে তার স্বামী ঘরে ঢুকে ওই তরুণীর মুখমণ্ডলসহ শরীরে অ্যাসিড ছুড়ে মারেন।

ঘটনার পরদিনই ভুক্তভোগীর বাবা বাদী হয়ে জামাইসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা করেন। মামলায় আব্দুল মোতালেব এখন কারাগারে আছেন। নয় মাস পর গত বছরের ডিসেম্বর মাসে পুলিশ চার্জশিটও দিয়েছে। এখন ভুক্তভোগীসহ তার পুরো পরিবার আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি দেখার অপেক্ষায় আছেন।

সিরাজগঞ্জে ভুক্তভোগীর বাড়িতেই তার বাবা-মার সঙ্গে কথা হয়। তার বাবা এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমার মেয়ের বিয়ের সময় কথা হয়েছিল, কোনো টাকা দিতে পারবো না। তারপরও আমরা আত্মীয়-স্বজনের কথামতো মেয়ের সুখের জন্য জামাইকে টাকা দিয়েছিলাম। মেয়ে আমার বাড়িতেই থেকে পড়াশোনা করতো। জামাই মাসে মাসেই এখানে আসতো। মেয়েটা পড়াশোনা করতে যেয়ে পরিচিত প্রতিবেশী বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে কথা বললে সন্দেহ করতো। রাগারাগি করতো কিন্তু মেয়ে এসব কিছুই বলতো না।’

তিনি বলেন, ‘বিয়ের দেড় বছর পর জামাই মেয়েকে নিয়ে গেলো। টাকা চেয়ে চাপও দিয়েছিল। মেয়ে কথা না শোনায় দুইদিন পরেই আমার সুন্দর মেয়েটাকে অ্যাসিড মেরে শেষ করে দিল। করোনার মাঝেই কষ্ট করে সিরাজগঞ্জ সদর হাসপাতালে মেয়ের চিকিৎসা করালাম। এখনো মাঝে মাঝে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। মেয়ে আমার নাক দিয়ে নিঃশ্বাস নিতে পারে না। মাংস ঝলসে নাক বন্ধ হয়ে গেছে। মুখ দিয়ে যেটুকু নিঃশ্বাস নেয়। মেয়ে এখন মন খারাপ করে বসে থাকে, বাইরেও বের হয় না।’

jagonews24

মেয়েকে নির্যাতনের সুষ্ঠু বিচার চেয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে আমার মেয়ের মতো আর কোনো মেয়ে যেন এমন কষ্ট না পায়। আর আইনে যে সুষ্ঠু বিচার হয় আমরা সেই বিচার চাই।’

পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির মা জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা যতটুকু পারছি মেয়ের চিকিৎসা করেছি। কিন্তু কেউ সহযোগিতা করেনি। আমি গরিব মানুষ। টাকা নেই, কে আসবে আমাদের কাছে? এখন মানুষের মধ্যে আমার মেয়ে যেতে পারে না। ঢাকায় নিয়ে যেয়ে মানুষ সার্জারি করার কথা বলে কিন্তু এতো টাকাও তো আমাদের নেই। মেয়েটার চিকিৎসা ব্যবস্থার হলে কষ্ট কমতো।’

মেয়েটির বিয়ের সময় তার মামাতো ভাই রেজাউল উপস্থিত ছিলেন। খোঁজ নিয়ে তার সঙ্গেও এ প্রতিবেদকের কথা হয়। রেজাউল বললেন, ‘বিয়ের পর মেয়ের সুখের জন্য জামাইকে টাকা দেয়া হয়েছিল। আমরাও আশা করতাম ছেলেটা ব্যবসা-পাতি করুক। মেয়েটি আমাদের বাড়িতেই থাকতো। দেড় বছর পর নিয়ে গেল আর তিনদিনের মাথায় মুখে-পিঠে অ্যাসিড মারল। আমরা তো হতবাক! আমাদের মেয়ে কোনো অন্যায় করলে বা কথা না শুনলে আমাদের বলতো। আমরা তাকে বোঝাতাম। কিন্তু অ্যাসিড মেরে ওর সুন্দর জীবনটাই নষ্ট করে দিয়েছে।’

প্রতিবেশী আরেকজন নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘মেয়েটি মাদরাসায় পড়তো। মাদরাসায় আসা-যাওয়ার পথে কারোর সঙ্গে কথা বললে স্বামী নাকি রাগ করতো। বকাঝকা করতো। গ্রামের মেয়ে পরিচিত ভাই-বোনদের সঙ্গে দেখা হলে তো কথা হয়, সেজন্যও নাকি সন্দেহ করতো। কিন্তু আমাদের বোনকে নিয়ে কখনো কেউ খারাপ কিছু বলতে পারবে না।’

বাড়ির উঠোনেই চেয়ারে বসে থাকা ভুক্তভোগীর মুখোমুখি হতেই কাপড় দিয়ে মুখ ঢাকলেন। এরপর অনুমতি নিয়ে কথা বলতেই চাপা কণ্ঠে বলেন, আমি অনেক কষ্টে আছি। নাক দিয়ে নিঃশ্বাস নিতে পারি না। আমি আগের মতো আবার নিঃশ্বাস নিতে চাই। আমার চিকিৎসার প্রয়োজন। বলতেই দম বন্ধ হয়ে আসে তার। কিছুক্ষণ চুপ থেকে তিনি আসামি স্বামীর সুষ্ঠু বিচারের দাবি করেন।

এওয়াইএইচ/এমআরআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।