হুথি বিদ্রোহীদের কব্জায় ৫ বাংলাদেশির ভয়ঙ্কর ৯ মাস
জাহাজের দীর্ঘযাত্রায় চোখ জোড়া বুজে এসেছিল চট্টগ্রামের যুবক রহিম উদ্দিনের। হঠাৎ দুলে ওঠা জাহাজে শুনতে পেলেন হুড়োহুড়ির শব্দ। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পাশের জাহাজটি ডুবতে শুরু করে। রহিম তখনও নিশ্চিত ছিলেন না নিজের পরিণতি সম্পর্কে। জাহাজের নাবিক ঘূর্ণিঝড় থেকে বাঁচতে রহিমদের জাহাজটি লোহিত সাগর থেকে ইয়েমেন উপকূলে নোঙর করান।
রহিমরা যখন নিজেদের নিরাপদ ভাবতে শুরু করলেন তখনই দেখা দিল বড় বিপদ, শুরু হলো গুলির বৃষ্টি। এই নির্জন উপকূলে গুলি কোথা থেকে আসবে! কিন্তু না, সেটা কোনো দুঃস্বপ্ন ছিল না। সত্যিই বৃষ্টির মতো গুলি চলছিল। প্রথমে ইয়েমেনের কোস্টগার্ড সদস্য পরিচয় দিয়ে জাহাজে ওঠে একদল অস্ত্রধারী। তারা পাঁচ বাংলাদেশিসহ ২০ নাবিককে ইয়েমেনের রাজধানী সানায় নিয়ে যায়। পরে জানা গেল তারা দেশটির ক্ষমতা দখলে লড়াইরত হুথি বিদ্রোহী।
দীর্ঘ প্রায় ৯ মাস ইয়েমেনে ওই বিদ্রোহীদের হাতে জিম্মি থাকার পর মুক্তি পেয়ে পাঁচ বাংলাদেশি নাবিক গত রোববার (১০ জানুয়ারি) সকালে দেশে ফিরেছেন। দেশে ফেরা পাঁচ নাবিক হলেন রহিম উদ্দিন, মোহাম্মদ ইউসুফ, মোহাম্মদ আলাউদ্দিন, মোহাম্মদ আলমগীর ও মোহাম্মদ আবু তৈয়ব। পাঁচজনেরই বাড়ি চট্টগ্রামে।
এর মধ্যে রহিম উদ্দিন মীরসরাই উপজেলার ৮ নং দুর্গাপুর ইউনিয়নের পূর্ব দুর্গাপুর গ্রামের শফিকুর রহমানের ছেলে, মোহাম্মদ ইউসুফ একই ইউনিয়নের পূর্ব দুর্গাপুর গ্রামের এবায়েত উল্লার ছেলে, মোহাম্মদ আলাউদ্দিন ৬ নং ইছাখালী ইউনিয়নের পশ্চিম ইছাখালী গ্রামের চুনিমিঝিরটেক এলাকার নুর মোহাম্মদের ছেলে, মোহাম্মদ আলমগীর একই ইউনিয়নের টেকেরহাট এলাকার নুরুল আবছারের ছেলে। এছাড়া মোহাম্মদ আবু তৈয়বের বাড়ি চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলায়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির তথ্যমতে, বাংলাদেশের এই পাঁচ নাবিক ওমানের মাছিরা নামের একটি জাহাজ কোম্পানিতে কাজ করতেন। তারা সৌদি আরবে নির্মাণকাজের উদ্দেশে গত ফেব্রুয়ারি মাসে ওমান থেকে জাহাজে যাত্রা করেন। ঝড়ের কবলে পড়ে জাহাজটি সাগরে ডুবে যায়। পরে তারা জীবিত অবস্থায় উদ্ধার হলেও ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের হাতে আটক হন। তাদের সঙ্গে ভারতীয় ১৪ জন এবং মিসরীয় একজন নাবিকও আটক ছিলেন। মোট ২০ জন ৯ মাস হুথি বিদ্রোহীদের হাতে বন্দি ছিলেন।
ইয়েমেনে হুথি বিদ্রোহীদের হাতে জিম্মিদশার বিবরণ দিচ্ছেন নাবিক রহিম উদ্দিন
বন্দি নাবিকদের দেশে ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারত সরকারও উদ্যোগী হয়। গত ২৮ নভেম্বর তাদের মুক্তি দিলে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার হেফাজতে নেয়া হয়। সেখান থেকে গতকাল তাদের ঢাকায় পাঠানোর উদ্যোগ নেয়া হয়। গত রোববার সকালে তারা ঢাকায় ফেরেন।
জিম্মিদশা থেকে ফিরে আসা নাবিক রহিম উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘ওমানের মাছিরা জাহাজ কোম্পানিতে দীর্ঘ ১২ বছর ধরে আমি নাবিক হিসেবে কর্মরত ছিলাম। গত বছরের ফেব্রুয়ারি (৩ ফেব্রুয়ারি) মাসে আমরা তিনটি জাহাজে সৌদি আরবের পথে রওনা দেই। যাত্রাপথে আরব সাগর থেকে লোহিত সাগরে প্রবেশের সময় আমাদের জাহাজগুলো প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে, এতে আমাদের একটি জাহাজ পুরোপুরি ডুবে যায়। ডুবে যাওয়া জাহাজের নাবিকদের উদ্ধার করে আমরা ঘূর্ণিঝড় থেকে বাঁচতে ইয়েমেন উপকূলে আশ্রয় নেই।’
‘যখন আমরা নিজেদের নিরাপদ ভাবতে শুরু করলাম, তখনই চারদিক থেকে হঠাৎ ব্রাশফায়ারের শব্দ শুনতে পেলাম। নির্জন সাগরে ব্রাশফায়ারের শব্দ আমাদের অবাক করেছিল। কিন্তু বাইরে তাকাতেই দেখি বেশ কয়েকটি পেট্রোল বোটে ৫০ জনের মতো অস্ত্রধারী আমাদের জাহাজে উঠছে। শুরুতে তারা নিজেদের ইয়েমেনের কোস্টগার্ড সদস্য পরিচয় দেয়। আমাদের সবাইকে (২০ জন নাবিক) বন্দি করে ইয়েমেনের রাজধানী সানায় নিয়ে যায়; পরে জানতে পারি ওরা ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহী।’
বন্দিদশায় নির্যাতনের বিবরণ দিয়ে রহিম উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘শুরুতেই তারা আমাদের সঙ্গে থাকা মোবাইল ফোন, টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেয়। পরে একটি ছোট রুমে আমাদের ২০ জনকে বন্দি করে রাখে দীর্ঘ ৯ মাস। নিজেদের ভেতর কথা বললে বা নড়াচড়া করলেই মারধর করা হতো, কথায় কথায় তারা অস্ত্রের ভয় দেখাত। হুথি বিদ্রোহীরা মানুষকে মানুষ বলে মনে করে না। সামান্য বিষয়ে ওরা গুলি করে মানুষ মারে। ছোট ছোট বাচ্চারা অস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে মানুষ হত্যা করে।’
ডুবে যাওয়া জাহাজের নাবিক মোহাম্মদ আলাউদ্দিন বলেন, ‘আমরা চারজন ১২ বছর ধরে ওমানে একটি জাহাজ কোম্পানিতে চাকরি করতাম। গত বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি ওই কোম্পানির তিনটি জাহাজযোগে পাঁচ বাংলাদেশি, ১৪ ভারতীয় ও এক মিসরীয় কোম্পানির নির্মাণকাজে সৌদি আরব যাচ্ছিলাম। পথে ১২ ফেব্রুয়ারি ইয়েমেনের বাবলমন্ডল এলাকায় আমাদের জাহাজ ঝড়ের কবলে পড়ে। প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়ে আমাদের জাহাজ (ডানাচিষ) ডুবে যায়। তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের অপর দুই জাহাজে গিয়ে আমরা প্রাণে রক্ষা পাই। এ সময় হঠাৎ ইয়েমেনের বিদ্রোহী গ্রুপ হুথির লোকজন কোস্টগার্ড পরিচয় দিয়ে কয়েশ রাউন্ড গুলি চালিয়ে দুই জাহাজে থাকা ২০ নাবিককে অপহরণ করে। পরে আল রাইয়া ও ফরিদা হয়ে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে আমাদের ১৪০০ কিলোমিটার দূরে নিয়ে সানা শহরে নিয়ে যায়; সেখানে একটি হোটেলে বন্দি করে রাখে।’
নিজেদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা জানান আলাউদ্দিন ও আলমগীর
আলাউদ্দিন বলেন, ‘২৪ ঘণ্টায় আমাদের শুধু এক বোতল পানি আর বাচালিয়া নামে এক ধরনের খাবার দেয়া হতো। দীর্ঘ ৯ মাস আমাদের না খেয়ে অনেক কষ্টে দিন পার করতে হয়েছে। কখনো ক্ষুধার জ্বালায় খাবার চাইলে মারধরের শিকার হতে হতো।’
দীর্ঘ বন্দিদশায় খাবারের কষ্ট নিয়ে রহিম উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘সারাদিনে মাত্র একবার খাবার দেয়া হতো। কখনো এক মুঠো ভাতের সঙ্গে এক টুকরো সেদ্ধ আলু দেয়া হতো। তেষ্টা মেটাতে দেয়া হতো ছোট বোতলে সামান্য পানি। আমরা খেতে পারছি নাকি পারছি না, এটা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। কথা বললেই মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে ভয় দেখানো হতো; অনেককে গুলি করে মেরেছে হুথি শিশু-কিশোররা।’
ভুক্তভোগী মোহাম্মদ আলমগীর জানান, প্রথম কয়েক মাস তাদের জাহাজের মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি। পরে কোম্পানির মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের উদ্ধারে সহায়তা চান। কিন্তু হুথি বিদ্রোহী গ্রুপের সদস্যরা মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে ১০ লাখ ডলার মুক্তিপণ দাবি করে। মালিক তাদের ২০ হাজার ডলার দেন। এরপর থেকে কোম্পানির মালিক বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন।
একটি মোবাইল ফোন জ্বালায় আশার প্রদীপ
রহিম উদ্দিন বলেন, এপ্রিল মাসের শেষ দিকে হোটেলের ম্যানেজারের মাধ্যমে ওমানে নিযুক্ত বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করি কয়েকবার। কিন্তু তিনি আমাদের কোনো ধরনের সহযোগিতা করেননি। তিনি বারবার সৌদি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন; কিন্তু আমাদের পক্ষে সেটি সম্ভব ছিল না। কয়েক মাস পর জাহাজ মালিক ২০ হাজার ডলার বিদ্রোহীদের দিলে তারা আমাদের একটা মোবাইল ফোন ব্যবহারের সুযোগ দেয়। ওই সময় ওমান সমিতি চট্টগ্রামের সভাপতি এয়াছিন চৌধুরীর মাধ্যমে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলমের সঙ্গে হোয়াটস অ্যাপে যোগাযোগ হয়।
ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের জিম্মিদশা থেকে মুক্তির আনন্দ তাদের চোখমুখে
মোহাম্মদ আলমগীর বলেন, ‘প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সঙ্গে যোগাযোগের পর আরও কয়েক মাস কেটে যায়। কিন্তু বন্দিজীবন থেকে কিছুতেই মুক্তি মিলছিল না। সেপ্টেম্বর মাসে আমাদের ইয়েমেনের আদালতে তোলা হয়। আদালতের মাধ্যমে আমরা ছাড়া পেয়েছি। তবে ইয়েমেনে বাংলাদেশি দূতাবাস না থাকায় কিছুতেই দেশে ফিরতে পারছিলাম না। পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কুয়েতে অবস্থিত বাংলাদেশি দূতাবাস, জর্ডান দূতাবাসের সহযোগিতায় ১৮ নভেম্বর হোটেল থেকে মুক্তি পেয়েছি। এরপর আমাদের ইয়েমেনে অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। ৩ ডিসেম্বর ইয়েমেনের আদেন নামক শহরে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর ৯ জানুয়ারি সেখান থেকে জিবুতি। জিবুতি থেকে দুবাই, দুবাই থেকে বাংলাদেশে এসে পৌঁছাই রোববার।’
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘ইয়েমেনের সানায় দীর্ঘদিন থেকে হুথিদের হাতে আটক হয়েছিলেন ওমানের একটি জাহাজ কোম্পানিতে কাজ করা বাংলাদেশি পাঁচ নাবিক। সাথে ভারতীয় নাগরিকও আটক ছিলেন। ১০ মাস ধরে আটক থাকা অবস্থার এক পর্যায়ে জাহাজ কোম্পানির মালিকের কাছ থেকে আংশিক মুক্তিপণ পাওয়ার পরে তাদের মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দেওয়া হয়। আটকদের মধ্যে একজন আমার সাথে প্রথম যোগাযোগ করেন। আমাদের ওমান ও কুয়েত দূতাবাস এবং জিবুতিতে ভারতীয় দূতাবাসের প্রচেষ্টায় তাদের দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।’
রহিম উদ্দিন বলেন, ‘আমরা প্রথমে দেশে ফিরে আসার কথা চিন্তাও করতে পারিনি। বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতায় দীর্ঘ ১০ মাস বন্দিজীবন শেষে মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তানদের কাছে ফিরতে পেরে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করছি।’
তিনি বলেন, ‘কোম্পানির মালিক দীর্ঘ বন্দিদশায় আমাদের কোনো খবর রাখেননি। অর্ধাহারে, অনাহারে আমাদের দিন কেটেছে। প্রায় এক বছরের বেতন বকেয়া রয়েছে। আমরা পররাষ্ট্র ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আমাদের পাওয়া বেতন দেয়ার দাবি জানাচ্ছি।’
আবু আজাদ/এইচএ/জেআইএম