ভিত্তিপ্রস্তরেই সান্ত্বনা !
শুধু ভিত্তিপ্রস্তর ও প্রতিশ্রুতির সান্ত্বনার মধ্যে রয়েছে বগুড়াবাসী। যুগ ধরে চলছে এই সান্ত্বনা। জোট কিংবা মহাজোট কোনো দলীয় সরকারই আগ্রহী হয়নি সান্ত্বনার এই প্রকল্পগুলোর বাস্তব রূপ দিতে। যার কারণে বগুড়াবাসীর প্রাণের দাবিগুলো এখন ভিত্তিহীন প্রকল্প হিসেবে মনে করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিংবা বেগম খালেদা জিয়া এই দুই দলের যারাই ক্ষমতায় থাকুক না কেন বগুড়ার উন্নয়নে তারা বরাবরই ছিলেন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর ভুলে গেছেন তাদের প্রতিশ্রুতির কথা। যার কারণে সরকার আসছে, সরকার যাচ্ছে কিন্তু বছরের পর বছর পড়ে থাকছে প্রকল্পগুলো।
টেলিভিশন কেন্দ্র :
৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের এবং পরে বিগত জোট সরকারের প্রতিশ্রুত প্রায় ২০ কোটি টাকার এই প্রকল্পটি এখন সান্ত্বনার প্রকল্প। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পর দেড় যুগেরও বেশি সময় অতিবাহিত হলেও কাজের অগ্রগতি কিছুই হয়নি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ১৯৯৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর শহরতলীর বাইপাস সড়কের পাশে ফুলদীঘিতে বাংলাদেশ টেলিভিশন বগুড়া আঞ্চলিক কেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তারা এই প্রকল্প বাস্তাবায়নে উদ্যোগী হয়। কিন্তু পরবর্তী ৫ বছর সেই প্রকল্প আর আলোর মুখ দেখেনি।
২০০১ সালের নির্বাচনে জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর টিভি কেন্দ্র স্থাপন কাজের পুনঃউদ্যোগ নেয়া হলেও তা করা হয়নি। সে সময় কাজ শুরু করার জন্য গণপূর্ত অধিদফতরকে প্রকল্প দাখিল করতে নির্দেশ দেয়া হয়। গণপূর্ত অধিদফতর ও জেলা প্রশাসন পরিদর্শন করে ৩ দশমিক ৯৮ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য ১ কোটি ২৪ লাখ টাকা এবং সীমানা প্রাচীর নির্মাণের জন্য ৭০ লাখ টাকার প্রয়োজন দেখিয়ে প্রকল্প দাখিল করে। জোট সরকারের সময়েই সীমানা প্রাচীর নির্মাণের জন্য গণপূর্ত অধিদফতর দরপত্র আহ্বান করে। পরবর্তী সময়ে ঢাকার রামপুর টেলিভিশন কেন্দ্রের এক চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে বগুড়ার গণপূর্ত বিভাগ বগুড়া টেলিভিশন কেন্দ্রের জন্য মোট প্রাক্কালন ব্যয় ১৯ কোটি ২০ লাখ ১৭ হাজার ৯২৩ টাকা ধরে একটি প্রতিবেদন দাখিল করে। তাতে তিনতলা ভবনসহ রেস্ট হাউজ, জিএম বাংলো, স্টাফ কোয়ার্টার, পুলিশ ব্যারাক, প্রিন্সিপাল, ক্যান্টিন এবং সিকিউরিটি রুম, অভ্যন্তরীণ বিদ্যুৎ এবং লিফটের প্রস্তাব করা হয়। দেড় যুগ ধরে সেই প্রস্তাব ভিত্তিহীন অবস্থাতেই পড়ে রয়েছে।
২য় শিল্প এলাকা নির্মাণ :
প্রতিশ্রুতি ছিল শিল্পের শহরখ্যাত বগুড়ায় বিসিক ২য় শিল্প নগরী সম্প্রসারণ কাজ করা হবে। কিন্তু এই প্রকল্পটিও শুধু ভিত্তিফলকে সীমাবদ্ধ। দেড় যুগ ধরে প্রতিশ্রুতির ভিত্তিফলক পড়ে রয়েছে ওয়াদার সাক্ষী হয়ে। আর ঠিক এই কারণে বগুড়ায় গ্যাস এলেও শুধু প্লটের অভাবে এখানে শিল্প স্থাপন ব্যাহত হচ্ছে। বিসিকে যে ২৩০টি প্লট ছিল তা অনেক আগেই বরাদ্দ হয়ে গেছে। এরপর অনেকে শিল্প স্থাপনের উদ্যোগ নিলেও প্লটের অভাবে তা পারেননি। বগুড়ায় শিল্প প্রসারের কথা বিবেচনা করে ১৯৯৮ সালে জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভায় বিসিক শিল্প নগরী সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়া হয়।
সভায় সর্বসম্মতিক্রমে শিল্প মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশলী কর্পোরেশন শহরতলির ছয়পুকুরিয়ায় ভারী শিল্প স্থাপনের জন্য যে ১৫ দশমিক ৪২ একর জমি অধিগ্রহণ করেছিল সেখানে বিসিক সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। জমিটি পেতে বিসিক কর্তৃপক্ষ আবেদন করলেও দেড় যুগেও শিল্প মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে কোএা পদক্ষেপ নেয়নি। অথচ ভারী শিল্প স্থাপনে শিল্প মন্ত্রণালয় ছয়পুকুরিয়ায় ১৯৮০ সালে জমিটি অধিগ্রহণ করে। এরপর সেখানে একটি ভিত্তিপ্রস্তরও স্থাপন করেন।
ফুটবল স্টেডিয়াম :
বগুড়ার একমাত্র ফুটবল স্টেডিয়াম শহীদ চান্দু ফুটবল স্টেডিয়ামকে রূপান্তর করা হয় আর্ন্তজাতিকমানের ক্রিকেট স্টেডিয়াম হিসেবে। জোট সরকারের সময় এই উদ্যোগকে বগুড়াবাসী সম্মিলিতভাবে সাধুবাদ জানিয়েছিল। সকল শ্রেণির খেলোয়াড়রাও উৎসাহিত হয়েছে। কিন্তু সেই সময় থেকে পরবর্তী প্রতিটি সরকার প্রতিশ্রুতি দিলেও আলাদা ফুটবল স্টেডিয়াম নির্মাণ করা হয়নি।
জেলা প্রশাসন থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, বগুড়ায় ফুটবল স্টেডিয়াম নির্মাণ করার জন্য সম্ভাব্য স্থান হিসেবে বগুড়ার ভারী শিল্প কারখানার জন্য নির্ধারিত মাঠ, ফুলবাড়ি সংলগ্ন এলাকায়, বগুড়া সুত্রাপুর কৃষি ফার্ম মাঠ ও মাটিডালি এলাকায় কয়েকটি স্থানে জরিপ চালানোর কাজ করা হয়। ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের কয়েকটি টিমও দফায় দফায় পরিদর্শন করে সম্ভাব্য মাঠগুলো। বর্তমানে বগুড়ার প্রতিভাবান ফুটবল খেলোয়াড়রা শহরের কেন্দ্রস্থল আলতাফুন্নেছা মাঠে ফুটবল খেলে থাকেন। এটি পৌরসভা নিয়ন্ত্রিত একটি মাঠ। এই মাঠেরও কোনো নিরাপত্তা নেই।
ব্যবসায়ী বিপণি বিতান :
বগুড়া শহরের অভ্যন্তরে সড়ক সম্প্রসারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের পুর্নবাসনের জন্য এখানে দেশের অন্যতম বিপণি বিতান নির্মাণ করার কথা ছিল। এই মার্কেটের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৩ কোটি টাকা। এই বিপণি বিতানের নকশা চুড়ান্ত করা হয়। সাত তলার এই বিপণি বিতানে কাঁচা বাজার থেকে শুরু করে সোনার গহনা পর্যন্ত বিক্রির ব্যবস্থা করার কথা ছিল। কিন্তু আজ পর্যন্ত এটির কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি। অথচ জোট সরকারের প্রতিশ্রুতি মোতাবেক তাদের শাসনামলেই এই কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। বর্তমানে মহাজোট ক্ষমতায় এলেও বগুড়ার এই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের পুর্নবাসনের ব্যাপারে কোনো অঙ্গীকার দেয়নি।
উল্লেখ্য, বিগত ২০০৫ সালে বগুড়া শহরের বনানী থেকে মাটিডালি পর্যন্ত ৯ কিলোমিটার সড়ক সমপ্রসারণ করার কারণে প্রায় ১ হাজার ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে নির্মিত হওয়ার কথা এই মার্কেট। এতে ক্ষতিগ্রস্থ ব্যবসায়িরা সহজ শর্তে দোকান বরাদ্দ পাওয়ার কথা। মার্কেটের জন্য স্থান নির্ধারিত হয়েছিল শহরের কেন্দ্রস্থল সাতমাথার পশ্চিমে রেলওয়ে ময়দান।
শিশু হাসপাতাল :
বগুড়াসহ সমগ্র উত্তরাঞ্চরের শিশুদের উন্নত চিকিৎসা সেবা দিতে বগুড়ায় জিয়াউর রহমান শিশু হাসপাতাল নির্মাণ কাজ শেষ হলেও যন্ত্রাংশ কেনার টাকার অভাবে সেটি চালু করা যাচ্ছে না। এই হাসপাতালটির শয্যা সংখ্যা ছিল ৫০টি। শিশু হাসপাতাল নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ২ কোটিরও বেশি টাকা। শিশু হাসপাতালটি শুধু বগুড়ারই নয় সমগ্র উত্তরাঞ্চলের শিশুদের উন্নত চিকিৎসা সেবা প্রদান করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। বিনামূল্যে নয়, তবে অতি কম খরচে এখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সেবা পাওয়ার কথা আগতদের। প্রথম পর্যায়ে হাসপাতালের নিচ তলায় জরুরি বিভাগসহ ৫টি বেড, দ্বিতীয় তলায় আইসিইউ, পোস্ট ওটি, এসসিবিইউ, নিও ন্যাট বিভাগের ২৪টি ও তৃতীয় তলায় আরো ২০টি বেড রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। হাসপাতালটি চালু হলে এই অঞ্চলের শিশুদের উপকার হলেও তা করা হচ্ছে না।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় : ১৪ বছর আগে সপ্তম জাতীয় সংসদের শেষ অধিবেশনে পাস হয়েছিল বগুড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্প। এরপর কয়েক দফা রাষ্ট্র ক্ষমতার পালা বদল হলেও আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি বিশ্ববিদ্যালয়টি। সিদ্ধান্ত হওয়ার পরও উত্তরাঞ্চলের প্রাচীন এই জনপদে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা না হওয়ার পেছনে রাজনৈতিক ব্যর্থতাকেই দায়ী করছেন শিক্ষাবিদরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বগুড়ায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের জন্য ২০০১ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদের শেষ অধিবেশনে বগুড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস করেছিল রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ। বিশ্ববিদ্যালয় নেই দেশের এমন ১২টি জেলায় ১২টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য নেয়া প্রকল্পের অংশ হিসেবে ওই বছরের ১৫ জুলাই গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয় এই আইন।
সময়ের বিবর্তনে প্রস্তাবিত বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আলোর মুখ দেখলেও আজও বঞ্চিতই রয়ে গেছে বগুড়া। আইনটি পাসের পর বিএনপি একবার এবং আওয়ামী লীগ পর পর দুইবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু বগুড়ায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আর কোনো উদ্যোগ নেয়নি তারা।
বগুড়ার প্রবীণ শিল্পপতি ও বগুড়া চেম্বারের সাবেক সভাপতি আমজাদ হোসেন তাজমা জানান, বগুড়া হচ্ছে ঐতিহ্যের শহর, ব্যবসার শহর। এ কারণে বগুড়াকে উত্তরাঞ্চলের মডেল সিটি বলা হয়। বগুড়ার উন্নয়নে শুধু প্রতিশ্রুতি না দিয়ে যদি সরকার উদ্যোগী হয় তবেই বগুড়া তার হারানো গৌরব ফিরে পাবে।
বগুড়া নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব তৌফিক হাসান ময়না মনে করেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় একটি জেলার পরিচিতি পেতে পারে না। এখানে বিএনপির যেমন ভোট রয়েছে তেমনি আওয়ামী লীগের ভোট সংখ্যাও কম নয়। এ কারণে উন্নয়ন বঞ্চিত করা রাখা ঠিক সিদ্ধান্ত নয়।
এসএস/এসএম