কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার


প্রকাশিত: ০৬:৪৭ এএম, ১২ নভেম্বর ২০১৫

মাত্র এক সপ্তাহে ৩০ লক্ষ ঘন ফুটের কয়েকগুণ বেশি বালু উত্তোলন সম্ভব। সেখানে গত ছয় বছরেও ৩০ লক্ষ ঘন ফুট বালু উত্তোলন শেষ করতে পারেনি কুষ্টিয়ার ২১টি বালু মহালের দখলদার প্রভাবশালী মহল। উচ্চ আদালতকে ভুল তথ্য ও ব্যাখা দিয়ে কুষ্টিয়ার ২১টি বালু মহাল গত ছয় বছরেরও বেশি সময় ধরে ভোগ দখল করে রেখেছে স্থানীয় প্রভাবশালী মহল।

বিশেষজ্ঞদের অভিমত, এ সময়ে তারা কয়েক কোটি ঘনফুট বালু উত্তোলন করে নিয়েছেন। আর সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে চক্রটি হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। এ অবস্থায় অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে কুষ্টিয়ার ২১টি বালু মহালকে রক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক সৈয়দ বেলাল হোসেন। কুষ্টিয়ার  মোটা বালুর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এর বাজার দরও অনেক বেশি।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ছাড়াও বিএনপির একাধিক বালু খেকো নেতা রয়েছেন এই চক্রের সঙ্গে। জেলা প্রশাসন থেকে গত কয়েক বছর ধরে বারবার তাগিদ দেয়ার পর সরকারের উচ্চ মহল নড়েচড়ে বসে। গত ২ নভেম্বর প্রভাবশালী মহলের দায়ের করা আটটি রিট খারিজ করে দেন উচ্চ আদালত। এ কারণে প্রভাবশালী এই চক্রটি জেলা প্রশাসক সৈয়দ বেলাল হোসেনের উপর চরম খেপেছেন। কয়েক মাস আগে শাওন এন্টারপ্রাইজের মালিক আবু সাঈদ খান ও বিশ্বাস এন্টারপ্রাইজের মালিক টনি বিশ্বাসের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী নিগার সুলতানা কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসককে উকিল নোটিশ প্রদান করেছে।

জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, গত ৮ অক্টোবর বাস্তব ও সচিত্র চিত্র তুলে ধরে সর্বশেষ অবস্থা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বরাবর এবং উচ্চ আদালতে চার পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক। ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, জেলার ২১টি বালু মহাল নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে বিভিন্ন রিট মামলা চলমান থাকায় বাংলা ১৪১৭ সাল থেকে ইজারা প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। রিট মামলা দায়েরের পূর্বে প্রতি বছর সরকার এক কোটি ৪ লাখ টাকার বেশি আয় করতো বালু মহালগুলো থেকে। সে মোতাবেক ছয় বছরে সরকারের ১২ থেকে ১৩ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে।

প্রতিবেদনে বিআইডব্লিউটিএ এর কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজসে তাদের কাছ থেকে ছয় মাস মেয়াদে বালু উত্তোলনের অনুমতি নিয়ে দীর্ঘ ছয় বছর যাবৎ কয়েক কোটি গুণ বালু উত্তোলন করে নিয়েছে। অথচ কাঙ্খিত বালু উত্তোলন হয়নি মর্মে ভুল তথ্য/ব্যাখা প্রদান করে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে বিভিন্ন সময়ে রিট মামলা দায়ের করে প্রতি বছর সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হানি করছে।

জেলা প্রশাসক সৈয়দ বেলাল হোসেন বলেন, একটি অসাধু চক্র দীর্ঘদিন বালু মহাল থেকে বালু উত্তোলন করে আসছে। মহামান্য আদালতকে তারা ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে রিট মামলা দায়ের করেছে। এ কারণে বালু মহাল ইজারা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে। তবে সম্প্রতি এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে।

এ বিষয়ে ভূমি ও আইন মন্ত্রণালয় থেকে আদালতে কৌশলী নিয়োগ করা হয়েছে। উচ্চ আদালত আটটি রিট মামলা খারিজ করে দিয়েছেন। বাকি রিটের ব্যাপারে প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।

জেলা প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বিআইডব্লিউটিএ বেশ কিছু শর্তে ছয় মাসের জন্য নদীর তলদেশ থেকে মাটি ও বালু উত্তোলনের জন্য অনুমতি নেন কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। ৩০ লক্ষ ঘনফুট বালু উত্তোলণের অনুমতি দেয়া হয় তাদের। অথচ এরপর থেকে গত ছয় বছর তারা কোটি কোটি ঘনফুট বালু উত্তোলন করে নিয়েছেন। উচ্চ আদালতকে ভুল তথ্য ও ব্যাখা দিয়ে তারা এসব বালু মহাল নিজেদের দখলে রাখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।

জানা গেছে, গত ২৭  জুলাই ২০১৪ সালে বিআইডব্লিউটিএ এক স্মারকমূলে একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করে যে, যারা বালু উত্তোলনের জন্য লিজ নিয়েছেন তাদের কেউই শর্তানুযায়ী বালু উত্তোলনের সঠিক হিসাব বিআইডব্লিউটিএ কার্যালয়ে জমা প্রদানের কথা থাকলেও তা দাখিল করেননি। অফিস কর্তৃক নির্ধারিত উত্তোলনযোগ্য ১০ লক্ষ ঘনফুট বালু ২৪ জুলাইয়ের আগেই উত্তোলন করেছেন। একই প্রতিবেদনে কথিত ইজারাদাররা যাতে আর বালু উত্তোলন করতে না পারে সেজন্য কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসককে অনুরোধ করে পত্র দেয়া হয়।

জেলা প্রশাসক জানান, ধুলট মহলের পার্শ্বে পশ্চিম তালবাড়িয়া নামক অপর একটি তড়িয়া মহলের সৃষ্টি হয়েছে। এসব তড়িয়া মহলে যে সকল নৌকা/ট্রলার বালু বহন করে নিয়ে এসে জমা করছে তা থেকে প্রতিনিয়িত খাস আদায়ের মাধ্যমে সরকারি রাজস্ব আদায়ের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।

জানা গেছে, ২১টি বালু মহালের মধ্যে রয়েছে কুষ্টিয়া সদর উপজেলার বাহাদুরখালী, মহানগর, চকুয়াদামা ও শুকদেবপুর, জুগিয়া, মৌজার বালু মহাল। ভেড়ামারা উপজেলার পশ্চিম চরদাদাপুর, চরগোলাগনগর-আরাজীসাড়া ও রূপপুর বালু মহাল। মিরপুর উপজেলার ঘোড়ামারা-রানাখড়িয়া, চরমাদিয়া, পশ্চিম দাদাপুর, মিনাপাড়া ও চর তালিবাড়িয়া বালু মহাল। কুমারখালী উপজেলার লাহিনীপাড়া, জয়নাবাদ-ছেঁউড়িয়া, সেরকান্দি-আগ্রাকুণ্ডা-তেবাড়ীয়া-বরুরিয়া, পাথরবাড়ীয়া-উত্তর হিজলাকর-এনায়েতপুর, গোবিন্দপুর, ভাড়রা-এলঙ্গী বালু মহাল। খোকসা উপজেলার চাঁদট-ভবানীপুর-গনেশপুর-কোমরভোগ এবং ওসমানপুর বালু মহাল। ২০০৮ সালে স্থানীয় জেলা প্রশাসন থেকে সর্বশেষ বালু মহালগুলোর ইজারা ডাকা হয়। এরপর থেকে আর কোন ইজারা দেয়া সম্ভব হয়নি।

অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, শাওন এন্টারপ্রাইজ, বিশ্বাস এন্টারপ্রাইজ, আরজু এন্টারপ্রাইজ, জিয়া এন্টারপ্রাইজ, আনোয়ারুল হক মাসুম এন্টারপ্রাইজের নামে বালু মহাল ভোগ দখল হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক প্রকৌশলী জানান, মাত্র ৩ থেকে ৭ দিনে ৩০ লক্ষ ঘন ফুটের অনেক বেশি বালু উত্তোলন করা সম্ভব। সেখানে ছয় বছরে কোটি কোটি ঘুন ফুট বালু উত্তোলন করা হয়েছে নদী থেকে। সর্বশেষ পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব মতে ২০ জুন থেকে ২৫ জুন ৬ দিনে ২ কোটি ৭১ লক্ষ ২১ হাজার ৬২ ঘনফুট বালু উত্তোলন করা হয়েছে। যার মূল্য ১৬ কোটি ২৭ লক্ষ ২৬ হাজার ৩৭২ টাকা।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পদ্মা ও গড়াই নদীর নাব্যতা রক্ষার কথা বলে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সহযোগিতায় বিএনপি নেতা আনোয়ারুল হক মাসুম বিআইডাব্লিউটিএ থেকে অনুমতি নিয়ে অবৈধভাবে ভেড়ামারায় বালু উত্তোলন শুরু করেন। উপজেলা প্রশাসন ২০০৯ সালে এ বিষয়ে দরপত্র আহ্বান করতে গেলে মাসুম হাইকোর্টে রিট করেন। জানা গেছে, মাসুমকে বিআইডাব্লিউটিএ থেকে ৩০ লক্ষ ঘনফুট বালু উত্তোলনের অনুমতি দেয়া হয়।

জেলা প্রশাসক জানান, যারা দাবি করছে ৩০ লক্ষ ঘনফুট বালু উত্তোলন শেষ হয়নি, তারা সবাই এক সঙ্গে আসলে আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ওই পরিমাণ বালু উত্তোলন করে দেব প্রয়োজনে।

কুষ্টিয়ার বালু মহালের বৈধ ইজারাদার দাবিদার বিএনপি নেতা আনোয়ারুল হক মাসুম জাগো নিউজকে জানান, আমিই একমাত্র ব্যক্তি বিআইডাব্লিউটিএ এর কাছ থেকে বৈধভাবে ৩০ লাখ ঘনফুট বালু উত্তোলনের অনুমোদন নিয়েছি। ৩০ লক্ষ ঘনফুট বালু উত্তোলন করতে কত বছর লাগে জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

আল-মামুন সাগর/এমজেড/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।