স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়িয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো


প্রকাশিত: ০৯:৫৪ এএম, ০৯ নভেম্বর ২০১৫

‘গ্রামের অধিকাংশ মানুষ হতদরিদ্র। নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা প্রায় সকলের। বাড়ি থেকে বাজারে আসা যাওয়ার রিকশা ভাড়া ৭০-৮০ টাকা লাগে। পল্লী চিকিৎসকরাও ওষুধ ও ফি-সহ কয়েকশ টাকা বিল করেন। এ জন্য রোগ-ব্যাধি হলে চিকিৎসার জন্য কোথাও যাওয়ার চিন্তা কখনো করা হতো না। তাই ৫ বছর আগেও শরীরের ভেতর পুষে রাখা হতো রোগ। এভাবে ধীরে ধীরে কাবু হয়ে অনেক স্বজন অকালে পৃথিবী ছেড়েছেন। কিন্তু এখন পরিস্থিতি পাল্টেছে। বাড়ির পাশেই মিলছে ফ্রি চিকিৎসা সেবা। স্বাস্থ্যকর্মীরা আন্তরিকভাবে দেখে সাধ্যমতো ওষুধও দেয়। তাই মৌসুমী অথবা যেকোনো ধরনের রোগের লক্ষণ দেখা দিলেই হাজির হচ্ছি কমিউনিটি ক্লিনিকে।’

কক্সবাজারের রামু উপজেলার দুর্গম পাহাড়ি জনপদ ঈদগড়ের বড়বিল এলাকার জমির হোসেন (৭৫) বড়বিল কমিউিনিটি ক্লিনিক কার্যক্রম চালুর পর নিজেদের স্বাস্থ্য সচেতনতার বিষয়ে এমনটিই মন্তব্য করেছেন।

শুধু তিনি নন, পার্শ্ববর্তি গ্রাম কাটাজঙ্গল এলাকার নুর মুহাম্মদ (৬৫), দিলদার বেগম (৫৫), বায়তুশ শরফ পাড়ার সায়রা বেগমসহ (৫০) চিকিৎসা নিতে আসা আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা জমির হোসেনকে সমর্থন করেন।

সায়রা বেগম শ্বাসকষ্ট জনিত রোগে ভুগছেন। তার দেড় বছরের নাতনী আয়েশাও ঠাণ্ডা লাগার কারণে নিশ্বাস নিতে পারছে না। করণীয় সম্পর্কে জানতে তারা ক্লিনিকে এসেছেন।

তিনি জানান, তাকে প্রায় হাসপাতালে যেতে হতো। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বিনা খরচে সেবা নিতে গিয়ে হয়রানির শিকার হয়েছেন কয়েকবার। কিন্তু বর্তমানে গ্রামের অন্য মানুষের মতো প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য তার শেষ ভরসাস্থল হয়ে দাঁড়িয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিকই। তাই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যেন এ প্রকল্পটি গুরুত্ব সহকারে পরিচালনা করে এই প্রত্যাশা সায়রার।

ঈদগড় বড়বিল কমিউনিটি ক্লিনিকের কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) কর্মী এস এম রেজাউল কমির রাজু জাগো নিউজকে জানান, কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মধ্যে গর্ভবতী মা ও নবজাতকের সংখ্যাই বেশি। গ্রামের অল্পশিক্ষিত অনেক গর্ভবতী মহিলার গর্ভধারণ-পরবর্তী সময়ে কী কী সমস্যা দেখা দিতে পারে বা প্রসবকালীন কী করা উচিত এসব নিয়ে তাদের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। বেশিরভাগ দম্পতিই জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করেন না বা জন্মনিয়ন্ত্রণ সংশ্লিষ্ট কোনো নিয়মকানুন সম্পর্কে অবহিত নন। আমরা সকলের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ দিয়ে স্বাস্থ্যসচেতন করার চেষ্টা চালাচ্ছি। একারণে একটু শারীরিক সমস্যা দেখা দিলেই ক্লিনিকের স্মরণাপন্ন হচ্ছেন এলাকার দরিদ্র জনগোষ্ঠি। প্রতিদিন গড়ে ৩৫-৫০ জন রোগীকে চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে। এভাবে ২০১৪ সালে তার ক্লিনিক সেবা প্রদানে জেলায় প্রথম হয় বলে জানান তিনি।  

তবে অনেক সীমাবদ্ধতার মাঝে কমিউনিটি হেলথ প্রোভাইডারদের কাজ করতে হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন রাজু। তার মতে, ৮০ ভাগ ক্লিনিকে বৈদ্যুতিক সংযোগ নেই। প্রতিটি ক্লিনিকে ডেলিভারি কক্ষের ব্যবস্থা করার কথা থাকলেও এখনো তা করা হয়নি (উপজেলা প্রতি ১টি করে চালু হয়েছে)। সরকার কর্তৃক সরবরাহকৃত বেশিরভাগ নোট বুক ও মডেম অকেজো হয়ে গেছে।

তিনি আরো জানান, ক্লিনিকে প্রায় ৩০ ধরনের ওষুধ সরবরাহ করা হয়। তবে সরবরাহকৃত এন্টিবায়োটিক চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। একজন স্বাস্থ্যকর্মীর (সিএইচসিপির) পক্ষে পুরো ক্লিনিকের দায়িত্ব পালন কষ্টসাধ্য। ক্লিনিকে একজন আয়া হলে আরো পরিচ্ছন্নভাবে কাজ করা যেত। প্রতি দেড় মাসের জন্য ক্লিনিক প্রতি যে একটি মেডিসিন কিট সরবরাহ করা হয়। তাতে শিশুদের জন্য যে ওষধ থাকে তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। দেড় মাসের শিশুর ওষধ এক সপ্তাহে শেষ হয়ে যায় বলে উল্লেখ করেন তিনি।

Comunity-Clinic
রামুর আরেক পাহাড়ি ইউনিয়ন কচ্ছপিয়ার সাবেক চেয়ারম্যান ও দক্ষিণ কচ্ছপিয়া কমিউনিটি ক্লিনিকের জমিদাতা মোকতার আহমদ জানান, মানুষের মৌলিক অধিকারের একটি হলো চিকিৎসাসেবা। দেশের মোট জনসংখ্যার বড় অংশই গ্রামে বাস করে। পিছিয়ে পড়া গ্রামের কৃষক ও হতদরিদ্র মানুষগুলো প্রতিনিয়তই বঞ্চিত হচ্ছেন কাঙ্খিত চিকিৎসাসেবা থেকে। একারণে মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার সরকারি উদ্যোগকে সমর্থন দিয়ে কমিউিনিটি ক্লিনিকের জন্য জমি দান করে ছিলেন তিনি। এখানে (তার এলাকায়) কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপিত হলেও নিয়োগ পাওয়া হেলথ প্রোভাইডারের অনুপস্থিতির কারণে বাস্তবসম্মত কোনো সেবা এলাকার লোকজন পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ সাবেক এ জনপ্রতিনিধির।
 
তিনি আরো বলেন, স্থানীয় কাউকে নিয়োগ না দিয়ে পার্শ্ববতি ইউনিয়নের নারী কর্মী নিয়োগ দেয়ায় তিনি কর্মফাঁকি দিচ্ছেন।

এ ব্যাপারে উপজেলা স্বাস্থ্য অফিসারকে একাধিকবার অভিযোগ করা হলেও কোনো কাজ হচ্ছে না।

তার মতে, নিয়োগ পাওয়া কর্মীরা একটু সচেতনভাবে দায়িত্বপালন করলে প্রান্তিক অঞ্চলে স্বাস্থ্য সচেতনতায় বিপ্লব আসতো। সরকারি সিদ্ধান্তটি সফল হতো।

জেলা স্বাস্থ্য কমিটির সদস্য ও ঈদগড় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমদ ভুট্টো জানান, উপজেলা পর্যায়ে একটি কমিউনিটি ক্লিনিকে ডেলিভারি ওয়ার্ড চালু হয়েছে এবং এখানে প্রায় প্রতিনিয়ত ডেলিভারি হচ্ছে। তবে বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় ডেলিভারি কার্যক্রমে ভোগান্তি পেতে হয়।   

তার মতে, সিএইচসিপি কর্মী নিয়োগ দেয়া হলেও তারা নিয়মিত বেতন-ভাতাদি পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। চাকরিতে আস্থা না থাকায় অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন অনেক সিএইচসিপি। তবে কমিউনিটি ক্লিনিক প্রান্তিক স্বাস্থ্যসেবায় সাড়া ফেলেছে। তাই এটি অব্যাহত রাখতে হলে সরকারকে সময়োপযোগি সিদ্ধান্ত নিতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, জেলার কুতুবদিয়ায় ১১টি, চকরিয়ায় ৪৩টি, পেকুয়ায় ১৪টি, মহেশখালীতে ২৭টি, কক্সবাজার সদরে ২৯টি, উখিয়ায় ১৫টি, টেকনাফে ১২টি ও রামু উপজেলায় ২৩টি কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রম সচল রয়েছে। এসব কমিউনিটি ক্লিনিক চালুর পর থেকে প্রতি উপজেলার মফস্বলের চিকিৎসা সচেতনতায় পরিবর্তন এসেছে বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও মেম্বারগণ। তবে, কিছু কিছু এলাকায় স্বাস্থ্যকর্মীদের কারণে হতদরিদ্ররা চিকিৎসা সেবা বঞ্চিত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তারা। এসব বিষয় তারা উপজেলা মাসিক সমন্বয় সভায় তুলে ধরেন বলেও দাবি করেন।   

কক্সবাজার সিভিল সার্জন কার্যালয়ের স্বাস্থ্য সেবা পরিসংখ্যান ইনচার্জ রাসেল মোস্তফা বলেন, প্রান্তিক পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর পাঁচ বছর মেয়াদে ১৮ হাজার ক্লিনিক স্থাপনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার কাজ শুরু করলেও ১০ হাজার ৭২৩টি ক্লিনিক চালু হয়। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে ক্লিনিকগুলো বন্ধ করে দেয়। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতা নিয়ে বন্ধ কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো চালুর উদ্যোগ নেয়। এ পর্যন্ত ১৩ হাজার ৫০০ ক্লিনিক স্থাপিত হয়েছে। এরমাঝে ১২ হাজার ৯০৬টি পুরোদমে চালু। প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে ৩০ ধরনের জরুরি ওষুধ বিনামূল্যে দেওয়া হয়। একেকটি ক্লিনিকের জন্য বছরে ওষুধের বাজেট ১ লাখ ১০ হাজার টাকা। কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের জন্য স্থানীয় জনগণ এ পর্যন্ত প্রায় ৮০০ একরের বেশি জমি দান করেছেন। এখন পর্যন্ত ১৩ হাজার ৭৮৪ জন হেলথকেয়ার প্রোভাইডার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

এর আওতায় কক্সবাজার জেলায় ১৭৪টি কমিউনিটি ক্লিনিক চালু রয়েছে। এসব ক্লিনিকের অনুকূলে ১৮০ জন সিএইচসিপি কাজ করছেন। আট উপজেলায় আরো ২৬টি নতুন ক্লিনিক নির্মাণের জন্য প্রস্তাবণা পাঠানো হয়েছে। ইতোমধ্যে ১৬টি নির্মাণে অনুমোদন এসেছে।  

কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. মো. কমর উদ্দিন জানান, উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে সবার চিকিৎসা সেবা শতভাগ নিশ্চিত করা সরকারের পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠে না। এরপরও কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রম সারাদেশে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। বর্তমানে গ্রামের ৮০ শতাংশ লোক এসব ক্লিনিকে সেবা নিতে আসেন উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, স্থানীয়দের নিয়ে ক্লিনিক পরিচালনা কমিটি থাকায় অনেক সমস্যা তারা সমাধান করে সেবা দিচ্ছেন। পাশাপাশি  সিভিল সার্জন অফিস থেকেও ক্লিনিকের কার্যক্রম নিয়মিত তদারক করা হয়। এরপরও কোনো ক্লিনিকে সেবা বন্ধ থাকলে তা দেখার দায়িত্ব সচেতন সবার। অভিযোগ পাওয়া গেলে সেসব কর্মীদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে উল্লেখ করেন সিভিল সার্জন।
 
এমএএস/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।