খাদ্যদ্রব্যের অবৈধ মজুত প্রতিরোধে আসছে কঠোর আইন

মাসুদ রানা
মাসুদ রানা মাসুদ রানা , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১০:০৬ পিএম, ১৮ অক্টোবর ২০২০

অডিও শুনুন

খাদ্যদ্রব্যের অবৈধ মজুত প্রতিরোধে কঠোর আইন করতে যাচ্ছে সরকার। এ জন্য ‘খাদ্যদ্রব্যের উৎপাদন, মজুত, স্থানান্তর, পরিবহন, সরবরাহ, বিতরণ ও বিপণন (ক্ষতিকর কার্যক্রম প্রতিরোধ) আইন, ২০২০’ এর খসড়া করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।

একইসঙ্গে ১৯৫৬ সালের দ্য ফুড (স্পেশাল কোর্ট) অ্যাক্টও পরিবর্তন করতে যাচ্ছে সরকার। খাদ্যপণ্যের উৎপাদন, মজুত, স্থানান্তর, পরিবহন, সরবরাহ, বিতরণ ও বিপণন সংক্রান্ত অপরাধের বিচার হবে স্পেশাল কোর্ট আইনের আওতায়।

সম্প্রতি চাল, পেঁয়াজ, তেলসহ বিভিন্ন ধরনের খাদ্যপণ্যের অবৈধ মজুতের মাধ্যমে ইচ্ছামতো দাম বাড়িয়ে ক্রেতাদের ভোগান্তিতে ফেলছেন একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। বিব্রত হচ্ছে সরকার। এই প্রেক্ষাপটে কঠোর আইন করার উদ্যোগ নিল খাদ্য মন্ত্রণালয়।

এ বিষয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের ‘দ্য ফুড গ্রেইনস সাপ্লাই (প্রিভেনশন অব প্রিজুডিশিয়াল অ্যাক্টিভিটি) অর্ডিন্যান্স ১৯৭৯’ রয়েছে। আইনটি অনেক পুরোনো। এটি হালনাগাদ করে নতুন আইন করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, ‘নতুন আইন অনুযায়ী খাদ্যদ্রব্যের উৎপাদন, মজুত, স্থানান্তর, পরিবহন, সরবরাহ, বিতরণ ও বিপণনের ক্ষেত্রে অপরাধের শাস্তি কঠোর হবে। দুষ্ট লোকদের অপরাধের ধরন পাল্টেছে, আমাদের সেটা শক্তভাবেই ডিল করতে হবে। আমাদের কাজের পরিধি বেড়েছে, নানা ধরনের প্রেক্ষাপট আমাদের সামনে আসছে। সেই বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে নতুন আইন করা হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই শাস্তি বাড়বে। বিশেষ খাদ্য আদালতের আওতায় এসব অপরাধের বিচার হবে।’

‘১৯৭৯ সালের আইন অনুযায়ী কেউ এই ধরনের অপরাধ করলে তিন মাসের আটকাদেশ দেয়া যেত। সেভাবে কোনো শাস্তির কথা ছিল না। ১৯৫৬ সালের ফুড স্পেশাল কোর্ট অ্যাক্টও আমরা নতুন করে করছি, এটি যুগোপযোগী করা হবে। খাদ্যদ্রব্যের উৎপাদন, মজুত, স্থানান্তর, পরিবহন, সরবরাহ, বিতরণ ও বিপণন (ক্ষতিকর কার্যক্রম প্রতিরোধ) আইনে উল্লেখ করা অপরাধগুলোর বিচার হবে স্পেশাল কোর্ট অ্যাক্টের আওতায়।’

খাদ্য সচিব আরও বলেন, ‘আমরা এখন খাদ্যদ্রব্যের উৎপাদন, মজুত, স্থানান্তর, পরিবহন, সরবরাহ, বিতরণ ও বিপণন (ক্ষতিকর কার্যক্রম প্রতিরোধ) আইনের খসড়ার বিষয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মতামত নিচ্ছি।’

খসড়া আইনে খাদ্যদ্রব্যের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, যেকোনো প্রকার দানাদার খাদ্যশস্য যেমন- চাল, ধান, গম ইত্যাদি; ভোজ্যতেল যেমন- সয়াবিন, পামওয়েল, সরিষা, সানফ্লাওয়ার ওয়েল, অলিভ অয়েল, সরিষার তেল এবং অন্যান্য সকল প্রকার ভোজ্যতেল, খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুতের কাঁচামাল, পেঁয়াজ, লবণ, চিনি, ডাল, প্রক্রিয়াজাত যেকোনো খাদ্যদ্রব্য এবং অন্যান্য প্রচলিত আইনে সংজ্ঞায়িত খাদ্য।

আইনের খসড়ায় খাদ্যদ্রব্যের উৎপাদন, মজুত, স্থানান্তর, পরিবহন, সরবরাহ, বিতরণ, বিপণন এবং এ-সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কাজের ক্ষেত্রে নানা কার্যক্রমকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।

মজুত সংক্রান্ত অপরাধ

ব্যক্তিগত ভোগের উদ্দেশ্য ছাড়া পরিবহন যান বা গুদামে বা যেকোনো স্থানে সরকার ঘোষিত পরিমাণের বেশি খাদ্যশস্য মজুত রাখা বা মজুত করা খাদ্যশস্যের হিসাব যথাযথ কর্তৃপক্ষকে দেখাতে ব্যর্থ বলে অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।

মজুত করা খাদ্যশস্যের উৎস সম্পর্কে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবহিত না করা বা গোপন করা। মজুত খাদ্যশস্যের মান বজায় রাখার উদ্দেশ্য প্রতিরোধ ও প্রতিকারমূলক যথাযথ পরিচর্যা নিশ্চিত না করায় খাদ্যশস্যের গুণগতমান কমে যাওয়া। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাদ্যশস্য সংরক্ষণ ও মজুত রাখাও হবে অপরাধ।

আরও যেসব কাজ অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে তা হলো- ‘এসেনশিয়াল কমোডিটি অ্যাক্ট, ১৯৫৬’ এবং প্রচলিত অন্যান্য আইনের আওতায় প্রয়োজনীয় লাইসেন্স গ্রহণ না করা। পুরোনো চাল বা অন্যান্য খাদ্যশস্য অবৈধভাবে গুদামে মজুত রেখে অসৎ উদ্দেশ্যে পলিশিং বা অন্যান্য রূপে মিশ্রণ করে অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের আওতায় সরকারি গুদামে সরবরাহ করা। অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের সময় গুদামে আমদানি করা চাল বা গম সরকারি গুদামে সরবরাহ করা।

স্থানান্তর সংক্রান্ত অপরাধ

খাদ্যশস্য স্থানান্তরকালে খাদ্যশস্যের মান বজায় রাখার জন্য প্রতিরোধ ও প্রতিকারমূলক যথাযথ ব্যবস্থা নিশ্চিত না করে খাদ্যশস্যের গুণগতমান কমে যাওয়া। পরিবহন করা খাদ্যশস্যের যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত না করা।

যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া মানুষের ভোগের অনুপযুক্ত খাদ্যশস্য এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তর করা। জনস্বাস্থ্য বা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর উপায়ে ভোগের অনুপযুক্ত খাদ্যদ্রব্য বিনষ্ট বা নিষ্পত্তি করা। ইনভয়েস বা চালানে উল্লেখ করা কেন্দ্রে খাদ্যশস্য খালাস না করে অন্যভাবে মজুত স্থানান্তর দেখানো। পরিবহনকালে ইনভয়েস বা চালানের সঙ্গে দেয়া নমুনা মোতাবেক খাদ্যদ্রব্যের পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের খাদ্যদ্রব্য গুদামে হস্তান্তর করা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।

পরিবহন সংক্রান্ত অপরাধ

যথাযথ চালান বা ডকুমেন্ট ছাড়া সরকারি-বেসরকারি খাদ্যশস্য একস্থান থেকে অন্যস্থানে পরিবহন এবং পরিবহনকালে খাদ্যশস্য আত্মসাৎ বা বিনষ্ট করলে অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।

সরবরাহ সংক্রান্ত অপরাধ

কর্মসূচির নামাঙ্কিত বিতরণকৃত সিল ছাড়া সরকারি গুদাম থেকে খাদ্যশস্যভর্তি বস্তা গ্রহণ, স্থানান্তর, মজুত, হাতবদল বা পুনরায় বিক্রি। বিতরণ করা সিলযুক্ত খাদ্যদ্রব্য ব্যবসার উদ্দেশ্যে ক্রয়-বিক্রয়কালে এই সম্পর্কিত লেনদেনের উপযুক্ত দলিল দেখাতে ব্যর্থ হলে। পুরোনো বা বিতরণ করা সিলযুক্ত বস্তা সরকারি গুদামে সরবরাহ করা- এক্ষেত্রে অপরাধ বলে গণ্য হবে।

বিতরণ সংক্রান্ত অপরাধ

সরকারের কোনো কর্মসূচির আওতায় বিধি অনুযায়ী নিযুক্ত ব্যবসায়ীরা ডিলার বা প্রকল্প চেয়ারম্যান বা অন্যকোনো ব্যক্তির মাধ্যমে খাদ্যদ্রব্য বিতরণকালে নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে কম বিতরণ করা। ভোক্তা বা উপকারভোগীর কার্ড ডিলার বা অন্যকোনো ব্যক্তির আটক রাখা হবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

বিপণন সংক্রান্ত অপরাধ

খসড়া আইন অনুযায়ী অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে, যদি খাদ্যসামগ্রী বিক্রি বা বিতরণের জন্য বিএসটিআইয়ের নির্ধারিত মানের বাটখারা বা পরিমাপক যন্ত্র ব্যবহার এবং সঠিক ওজনে ভোক্তার নিকট খাদ্যসামগ্রী বিক্রয় বা বিতরণ না করা হয়।

খাদ্যদ্রব্য ক্রয়-বিক্রয় সম্পর্কিত লেনদেনের হিসাব ও এ-সংক্রান্ত প্রমাণ সংরক্ষণ না করা। এ আইনের অধীন শ্রমিক, কর্মচারী, ঠিকাদার, মিলার, ডিলার বা অন্যকোনোভাবে নিযুক্ত ব্যক্তিদের খাদ্যদ্রব্য মজুত, স্থানান্তর, পরিবহন, সরবরাহ, বিতরণ, বিপণন বা এ-সংক্রান্ত কোনো কর্মসম্পাদনে বিরত থাকা। বা সম্পৃক্ত কোনো ব্যক্তিকে তার কর্তব্য পালনে বিরত থাকতে বাধ্য করা বা বিরত থাকতে প্ররোচিত করা। বা তাদের মধ্যে অসন্তোষ বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা বা দায়িত্ব পালনে বাধা সৃষ্টি করা অপরাধ হবে।

এছাড়া খসড়া আইন অনুযায়ী কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের খাদ্যদ্রব্যের উৎপাদন, মজুত, স্থানান্তর, পরিবহন, সরবরাহ, বিতরণ ও বিপণন সম্পর্কিত কোনো মিথ্যা তথ্য বা বিবৃতি তৈরি মুদ্রণ, প্রকাশ, প্রচার বা বিতরণ বা খাদ্যদ্রব্যের পর্যাপ্ততা সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে আতঙ্ক বা বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করাও হবে অপরাধ।

কী পরিমাণ খাদ্যপণ্য কতদিন মজুত করা যায়

কী পরিমাণ খাদ্যপণ্য বা খাদ্যসামগ্রী (চাল, ধান, গম, চিনি, ভোজ্যতেল, ডাল) কতদিন মজুত করা যাবে তা নির্ধারণ করে ১৯৫৬ সালের কন্ট্রোল অব এসেনশিয়াল কমোডিটির অ্যাক্টের অধীনে ২০১১ সালের ৪ মে একটি আদেশ জারি করে সরকার।

সেখানে চালের বিষয়ে বলা হয়েছে, সরকারের দেয়া লাইসেন্স ছাড়া কোনো ব্যবসায়ী এক টনের বেশি চাল বা খাদ্যশস্য তার নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে না।

লাইসেন্সধারী আমদানিকারক, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী ও চালকল মালিক বিভিন্ন মেয়াদে বিভিন্ন পরিমাণ চাল মজুত রাখতে পারবেন। পাইকারি পর্যায়ে একজন ব্যবসায়ী ৩০০ মেট্রিকটন ধান ও চাল ৩০ দিন পর্যন্ত মজুত রাখতে পারবেন।

ধান ও চালের ক্ষেত্রে খুচরা পর্যায়ে ১৫ টন ১৫ দিন মজুত রাখা যাবে। আমদানিকারক আমদানি করা ধান-চাল শতভাগ ৩০ দিন পর্যন্ত মজুত করতে পারবেন।

চালকল মালিক পর্যায়ে অটোমেটিক, মেজর ও হাসকিং চালকলের ক্ষেত্রে পাক্ষিক (১৫ দিনে) ছাঁটাই ক্ষমতার পাঁচগুণ ধান ৩০ দিন পর্যন্ত মজুত করা যাবে।

তবে চালের ক্ষেত্রে অটোমেটিক ও মেজর মিলের ক্ষেত্রে অনুমোদিত মজুতের পরিমাণ পাক্ষিক ছাঁটাই ক্ষমতার দ্বিগুণ। এ পরিমাণ চাল ১৫ দিন মজুত রাখা যাবে।

আদেশে বলা হয়েছে, আমদানিকারক বা পাইকারি বিক্রেতা অনুমোদিত মেয়াদের মধ্যে অনুমোদিত মজুত তার নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত কারণে বিক্রি করতে না পারলে অনুমোদিত মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন দিনের মধ্যে নির্ধারিত ছক ও পদ্ধতিতে সরকারের নির্ধারিত কর্মকর্তাকে জানাবে।

অনুমোদিত প্রত্যেক লাইসেন্সধারী ব্যবসায়ীকে খাদ্যসামগ্রী আমদানি, ক্রয়, মজুত ও বিক্রয়ের হিসাব লাইসেন্স দেয়া কর্তৃপক্ষের কাছে নির্ধারিত ছকে পাক্ষিক ভিত্তিতে প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে।

অপরদিকে সরকারের মনোনীত কর্মকর্তা ও লাইসেন্স প্রদানকারী কর্তৃপক্ষকে প্রাপ্ত তথ্যাদি প্রতি মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে খাদ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে হবে বলেও আদেশে উল্লেখ করা হয়েছে।

আরএমএম/বিএ/এমকেএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।