দ্বন্দ্বের জের : গাজীপুর থেকে ঢাকায় এনে খুন করা হয় ঠিকাদার সিরুকে
পারিবারিক কারণে গত ৩ অক্টোবর গাজীপুর গিয়েছিলেন সিরাজুল ইসলাম সিরু। সন্ধ্যার ঠিক আগে একটি কল আসে সিরুর মোবাইল ফোনে। এরপরই গাজীপুরের আত্মীয়ের বাসা থেকে ঢাকার শেখেরটেকের বাসায় ফিরে আসেন তিনি। ঘরে না ঢুকেই স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে যান। এরপর রাত সাড়ে ৯টার দিকে সিরু হত্যার খবর পান স্ত্রী জোছনা বেগম।
পরিবার বলছে, স্থানীয় প্রভাবশালী ও মাদক কারবারিদের যোগসাজশে সিরুকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিভিন্ন বিষয়ে দ্বন্দ্বের জেরে হত্যা করা হয়েছে সিরুকে।
মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ ও র্যাব-২ সূত্রে জানা যায়, মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যানের একতা হাউজিং এলাকায় গত ৩ অক্টোবর রাতে ৬-৭ জনের অংশগ্রহণে ঠিকাদার সিরাজুল ইসলাম সিরুকে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ।
স্থানীয়দের মাধ্যমে খবর পেয়ে রাত ৯টার দিকে মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। সিরু হত্যার পর অজ্ঞাতদের আসামি করে তার স্ত্রী জোছনা বেগম মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করেন।
জোছনা বেগম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার স্বামীর সাথে কারও শত্রুতা বা দ্বন্দ্বের তথ্য এর আগে কখনো পাইনি। সেদিন বাসায় এসেও ঘরে ঢোকেননি তিনি। তার ঢাকায় ফেরার খবরে রাতের খাবারের ব্যবস্থাও করেছিলাম। কিন্তু লোকটাকে রাতে আর খেতে দিতে পারিনি। ফিরেছেন লাশ হয়ে। তাকে যারা হত্যা করেছে আমি তাদের ফাঁসি চাই।’
সিরু হত্যায় সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগে ওই মামলায় র্যাব দুজন ও পুলিশ তিনজনকে গ্রেফতার করে । এর মধ্যে সুজন মিয়া, সজীব হোসেন রুবেল, অহিদ ও তানভীর নামে চারজন ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। সুমন শেখ নামে আরেকজন দুদিনের রিমান্ডে রয়েছেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, আর্থিক, প্রভাব বিস্তার ও ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে হত্যা করা হয়েছে সিরুকে।
নিহত সিরুর পরিবারের দাবি, সিরু মাদকবিরোধী কার্যক্রমে সক্রিয় ছিলেন। স্থানীয় প্রভাবশালী ও মাদক কারবারিদের যোগসাজশে সিরুকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে।
সিরুর বড় ছেলে মো. মামুন জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাড়ি নির্মাণে ইট, বালু, পাথর সরবরাহের কাজ করতেন বাবা। কয়েক বছর ধরে স্থানীয় কয়েকজনের কারণে কাজ করতে পারছিলেন না। বাধ্য হয়ে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র কাজ করতেন। শেখেরটেক, ঢাকা উদ্যানসহ আশপাশের এলাকায় ঠিকাদারির কাজ করছিলেন তিনি।’
মামুন বলেন, ‘আমার বাবা কেমন তা এলাকার যে কাউকে জিজ্ঞাসা করেন, বলে দেবে। আমরা বিশ্বাস করি, র্যাব বা পুলিশ যাদের গ্রেফতার করেছে তারা হয়তো বাবাকে খুন করেছে, কিন্তু তারা মূলহোতা নয়। তাদের সাথে বাবার কোনো স্বার্থের দ্বন্দ্বও ছিল না। গ্রেফতার সবাই আমার বয়সী। তাদের অন্য কেউ ব্যবহার করেছে। যারা তাদের দিয়ে আমার বাবাকে হত্যা করিয়েছে, তারা এখনো এলাকায় আছে। বুক ফুলিয়ে ঘুরছে। বাবার মৃত্যুর পরও হুমকি আসছে। তাদের গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে সব বেরিয়ে আসবে।’
সূত্র জানায়, সিরুর সঙ্গে স্থানীয় যুবলীগ ও শ্রমিক লীগের রাজনীতি করা দুজনের দীর্ঘদিনের বিরোধ চলছিল। সিরু যেসব জায়গায় ঠিকাদারির কাজ করতেন, সেখানেই বাধা দিতেন তারা। একইভাবে শেখেরটেক, ঢাকা উদ্যানসহ আশপাশের এলাকায় অন্যান্য নির্মাণাধীন প্রতিষ্ঠান থেকেও তারা নিয়মিত চাঁদা ওঠান। এই চাঁদা ওঠানোর ক্ষেত্রে বাধা দেয়ায় খুন করা হয় সিরুকে।
সিরুর বড় বোন রাশেদা বেগম বলেন, ‘আমার ভাই সেদিন ছিল গাজীপুরে এক আত্মীয়ের বাসায়। ঘটনার দিন সন্ধ্যা ৭টার দিকে হুট করেই বাসায় চলে আসে। বাসায় না ঢুকেই আবার বেরিয়ে যায়। আর ফিরে আসেনি।’
সিরুর ছোট ছেলে হাফেজ ইমন হাসান বলেন, ‘ব্যবসার কারণে বাবার চলাফেরায় ব্যস্ততা ছিল। পরিচিত একজনকে দিয়ে সেদিন সন্ধ্যায় বাবাকে কল করে ডেকে নেয়া হয়েছিল। হত্যার পর বাবার মানিব্যাগ ও মোবাইল ফোন কিছুই মেলেনি। বাবার নম্বরের কললিস্ট তালাশ করলেই সব বেরিয়ে আসবে।’
মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল লতিফ জাগো নিউজকে বলেন, ‘সিরুর ব্যবহৃত মোবাইল ফোনের কল রেকর্ড ডিটেইলস আমরা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে চেয়েছি। এটা পেলে তদন্তে অগ্রগতি আসবে আশা করছি।’
তিনি বলেন, ‘মোট পাঁচজন গ্রেফতার হয়েছে। এর মধ্যে ১৬৪ ধারায় চারজন আদালতে হত্যায় জড়িত থাকার ব্যাপারে স্বীকার করেছে। হত্যার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে পূর্বশত্রুতা। কী কারণে বা স্বার্থে এমন হত্যাকাণ্ড হয়েছে, তা তদন্ত করা হচ্ছে।’
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদপুর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) শরীফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘গ্রেফতার সুজন ও তার ভাই শাহিন ফোন করে সেদিন সিরুকে ডেকে এনেছিলেন। সুজন গ্রেফতার হলেও শাহিন পলাতক। তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পেরেছি তাদের হত্যায় ব্যবহার করা হয়েছে। নেপথ্যে যেই থাকুক তাকে খুঁজে বের করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।’
র্যাব-২ এর সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) এএসপি আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘টাকা-ব্যবসা নিয়ে সিরুর সাথে পূর্বশত্রুতা ছিল একটি পক্ষের। কয়েক মাস আগে সিরুর সাথে বাগবিতণ্ডা হয়েছিল। সিরু কিলিং মিশনে সুজনই নেতৃত্ব দিয়েছেন। তবে এর পেছনে আরও কেউ জড়িত বলে সন্দেহ পরিবারের। আমরা সেটা খতিয়ে দেখছি।’
জেইউ/এইচএ/এমকেএইচ