আতংক
এই গেল নবমীর রাতে রমনা কালিবাড়ি থেকে দুর্গা পূজার আয়োজন দেখে বের হচ্ছিলাম। সিকিউরিটির জন্য যে মেটাল ডিটেক্টর গেইট রাখা হয়েছে মূল মন্দিরের একটু আগে, সেখানে দেখলাম ওরা চারজন দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি ভেতরে মন্দিরের দিকে। মন্দিরের পাশে প্যান্ডেলে মাইকে উচ্চস্বরে গান হচ্ছে। তাদের পোশাক দেখে যে কারও দৃষ্টি পড়বে তাদের উপর। সবচেয়ে বড় বিষয়, তাদের দেখে একটু অবাকও হবে কেউ কেউ। কারণ তারা মাদ্রাসার ড্রেসেই এসেছে এবং অবয়বও বলে দিচ্ছে তারা মাদ্রাসার ছাত্র।
আজকাল মাদ্রাসার লেবাসে কাউকে দেখলে আতংকিত হয় লোকজন। বিশেষ করে ইয়াংদের দেখলে। আমার আবার সেই ভয় করে না। বরং আগ্রহ নিয়ে পরিচিত হতে ভালই লাগে। এদের ক্ষেত্রেও তাই করতে গেলাম। কিন্তু ওদের আতংকিত চেহারা। এই আতংক দু’বিষয়ে আছে আমি জানি। মাদ্রাসার ছেলেরা আজকাল সহজে কেউ তাদের জঙ্গি টাইটেল দিয়ে দেয় কিনা এই আতংকে থাকে। তাই অপরিচিত, অন্য লেবাসের লোকদের সঙ্গে পরিচিত হতে চায় না। দ্বিতীয় বিষয়, মাদ্রাসার ছেলে হয়ে রমনা কালিবাড়িতে পূজা দেখতে গেছে তারা- এটা একটা বেখাপ্পা বিষয়। কারও কারও কাছে নিন্দনীয়ও বটে।
আমি আশ্বাস দিয়ে বললাম, ভয় নেই। আমি কাউকে বলবো না কালিবাড়িতে দুর্গা দেখতে এসেছ। আমি নিজে একজন হাজী মানুষ। আমি দেখতে আসতে পারলে তোমরা তালেবানরা (ছাত্ররা) দেখবে না কেন! আস ছবি তুলি। এবার তাদের আরও বেশি লজ্জা। মাথা নিচু করে, মুখ লুকায়, একেবারে চোর ধরা পড়েছে ভঙ্গি করতে থাকায়- একটা ছবিও ভাল হচ্ছিল না। কথা বলে জানতে পারি তারা লালবাগের ইসলামপুরের একটি হাফেজিয়া মাদ্রাসায় পড়ে। ওখানেই থাকে। বৃহস্পতিবার তাদের ছুটি থাকে, শুক্রবারও হাফ বেলা ছুটি পায়। বন্ধুরা সবাই মিলে বৃহস্পতিবার এসেছে। কয়েকজন দূরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতরে আছে। মন্দিরের কাছে আসেনি।
চারজনের মধ্যে সাইদ এবং সাহাদুল নামে দু’জনের সঙ্গে ফোন নম্বর বিনিময়ও হয়। সে রাতে একটা টিভির নিউজ শোতে অংশগ্রহণের কথা ছিল আমার। আমি তাদেরকে দেখতে বললাম। তারা সবাই বললো, টিভি দেখতে পারে না। মাদ্রাসায় সে সুযোগ নেই। ভাবছিলাম তাদের আতংকিত হওয়া আর কিশোর উত্তীর্ণ বয়সের চপলতার কথা। ধর্মীয় শিক্ষার অনুশাসন তাদের সমবয়সীদের মতো তাদেরকে চপলতা প্রদর্শন থেকে বিরত রাখতে বাধ্য করছে। অনেক কিছুতে অবদমন করে চলতে হয় তাদের। আবার এই ধর্মীয় শিক্ষা আর লেবাসের কারণে তারা অনেকের চোখে সন্দেহের কারণ। জঙ্গি না হলেও তাদেরকে মিডিয়া এবং আইনের লোকরা জঙ্গি বানাতে পারে সহজে। তাদের এক আঁচড়ে ক্ষত পড়ে যেতে পারে তার জীবনে। হয়তো জেলও খাটতে হতে পারে বা মিথ্যা মামলায় কোর্টের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে হতে পারে। আসলে এটাও ভাবছিলাম শিক্ষা জীবন শেষে ওরা কি করবে! কোরআনে হাফেজ বা কোরআন বিশেষজ্ঞ, ইসলাম বিশেষজ্ঞ আমাদের সমাজে ক’জন দরকার! এই প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে তাদের এই শিক্ষা তাদেরকে কোথায় দাঁড়াতে দিবে!
অন্যদিক থেকে চিন্তা করলে ওই নিষ্পাপ চেহারার ছেলেগুলিই কিনা মূর্তিমান আতংক হয়ে দেখা দিচ্ছে ঠিক এই মুহূর্তের বাংলাদেশে। এরাই এখন সবচেয়ে বেশি আতংকজনক মানুষ বাংলাদেশে। জুব্বার নিচে কি চাপাতি আছে নাকি চাপাতি তার পেছনের কালো ব্যাগে! গায়ে রিমোট কন্ট্রোল বোমা নেইতো! ওদের দিকে যখন কেউ তাকায় অবচেতন মনে সেটা মাথায় আসে। রাস্তায় হাঁটার সময় পেছনে এই লেবাসের কোনও ছেলেকে হেঁটে আসতে দেখলে লোকজন মনে মনে হয়তো ভাবে- গর্দানে চাপাতি মারবে নাতো?
পরপর কয়েকটা ব্লগারকে হত্যার পর সর্বশেষ যখন দু’জন প্রকাশককে কোপালো এবং একজনকে মেরেই ফেললো তখন মাদ্রাসা আবার আলোচনায় আসলো। কারণ যে অবয়ব প্রত্যক্ষদর্শীরা দিচ্ছেন তাতে এমনই আঁচ করা যাচ্ছে। ধর্মবাদীদের কাজ এটা। আর ধর্মবাদীদের সফট টার্গেট মাদ্রাসার ছাত্ররা। হেন কোনও উগ্র কাজ নেই এদেরকে মোটিভেট করে করানো যাবে না। কিন্তু সব কি আসলে মাদ্রাসার ছেলেরা করছে? এই যে রাজিব নামের যে ব্লগারটিকে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের শুরুতে হত্যা করা হল, যারা ধরা পড়লো এবং স্বীকারোক্তি দিল তারাতো নামকরা এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এ ধরনের ছেলেরা দেখা যাচ্ছে একবার গ্রেফতার হয়ে জামিনে মুক্ত থেকে আবার একই কাজ করতে গিয়ে ধরা পড়ছে। ইন্টারনেট এখন সন্ত্রাস ছড়ানোর সবচেয়ে বড় মাধ্যম। যারা ছড়াচ্ছে তারা কি সবাই মাদ্রাসার ছাত্র? ক’জন মাদ্রাসার ছেলের নেট ব্যবহার করার সুযোগ আছে?
প্রশ্ন হচ্ছে পুলিশ এসব চাপাতি হত্যাকারিদের, বিশেষ করে ব্লগার হত্যাকারিদের ধরতে পারে না কেন? ওরা ধরা পড়লেও ছেড়ে দেয় কোন যুক্তিতে। বাবু নামের এক ব্লগার হত্যাকারীদের একজনকে কয়েকজন তৃতীয় লিঙ্গের লোক ধরেছিল? সে বিচারেও অগ্রগতি কোথায়? রাজিবের হত্যাকারীরা এতো চিহ্ন রেখে গেছে তাদের হত্যকাণ্ডের পর, তারপরও চূড়ান্ত বিচারের আগে আগে তারা জামিনে মুক্ত হয়ে যাওয়ায় এটা কি প্রমাণ হয় যে ব্লগারদের বিচারের ব্যাপারে সরকার উদাসিন? সরকার কি বিচারহীনতা, দায়মুক্তির সংস্কৃতিকে উৎসাহ দিচ্ছে নাকি গলদ অন্যখানে?
অন্যদিকে, জঙ্গি নয় এমন অনেকে কি জেল খাটছেন না জঙ্গির নামে? পুলিশ-র্যাব তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা চার্জশিট দিচ্ছে না? আমি একজনকে চিনি এইচএসসি পরীক্ষার আগে র্যাবের দৃষ্টিতে জঙ্গি হিসাবে মামলা খেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পাঠ শেষ করলেও তার মামলা চলছে। সাক্ষী আসেনা, মামলা নড়ে না... দিনের পর দিন হাজিরা দিতে হচ্ছে তাকে। একই আদালতে জঙ্গিরা মুক্ত হয়ে আবার চাপাতি হাতে নিচ্ছে। আবার জঙ্গি না হয়েও কেউ কেউ জঙ্গির সাজা পাচ্ছে।
জানি না আমরা কবে আইন-আদালতের এই চোর-পুলিশ খেলার চক্র থেকে বের হয়ে আসবো! কবে আমাদের চাপাতির ভয় কেটে যাবে! কবে আমরা প্রগতি, মুক্তচিন্তার নামে অন্যের ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত দেওয়া থামাবো! হযরত মোহাম্মদ(সঃ)-এর অনুসারী হয়েও তার সুন্নত থেকে বহু দূরে সরে যাওয়া আমাদের সন্তানরা কবে পরমত সহিষ্ণু হবে! কবে আমরা ধর্মবিদ্বেষ এবং ধর্মান্ধতা ছেড়ে পরস্পর আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খুঁজবো! কবে আমরা নির্ভয়ে একসঙ্গে বুক মেলাবো, ছবি তুলবো!
লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক
[email protected]
এইচআর/পিআর