সুপুরুষের স্বরূপ
সুপুরুষের স্বরূপ
রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা দেওয়া পাঁচ-সাতজন যুবকের মধ্য থেকে সহজেই আলাদা করা যায় তাকে। চারতলা থেকে যুবকটির দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে নন্দিতা। দুধে আলতা গায়ের রং এমন এক যুবক, একজন ছয় ফিটের মতো লম্বা, আরেকজন বডিবিল্ডারসহ কত রকমের যুবক দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তাদের কারোর মধ্যেই পরিপূর্ণতা নেই। শুধু ওই যুবকটি ছাড়া। তবে ওর আনোয়ার নামটা কেমন ক্ষেত ক্ষেত। তা না হয় নন্দিতা ওকে আনু বলেই ডাকবে।
অসাধারণ ব্যক্তিত্ব আর মায়াকাড়া হাসির যুবকটিকে প্রায় প্রতিদিনই তাড়িয়ে তাড়িয়ে দেখে নন্দিতা। কী অদ্ভুত পৌরুষত্ব আর শারীরিক গঠন ওর। লোমশ চওড়া বুক। মুক্ত দানার মত ঝকঝকে দাঁতে শিশুর মত সরল হাসি। যেন গ্রীক পুরাণের যুবক নারসিসাস। যে নিজের প্রতিমূর্তির প্রেমে পড়ে মারা যাওয়ার পর ফুলে রুপান্তরিত হয়।
বিকেলবেলা ওরা মোড়ে দাঁড়ালে চার দেয়ালে মন বসে না নন্দিতার। কোনো কারণে যুবকটি না এলে মন বিষন্ন হয়ে পড়ে ওর।
আজও আনোয়ার দাঁড়িয়ে আছে। বারান্দায় শুকাতে দেওয়া কাপড়গুলো ভাঁজ করছিল আর আড়চোখে দেখছিল ওকে। হয়তো যুবকটিও এদিকে তাকিয়ে আছে। তা দেখে নন্দিতার বুকের ভেতর এক ধরনের কাঁপুনি হয়। এসময় ভেতর থেকে নন্দিতার মার গলা ভেসে আসে-
আমাদেরে দুই কাপ চা দেও।
পাঁচ তলার ফ্ল্যাটের সুপ্তির মায়ের সাথে আলাপ করছে মা। তাদের দুজনের বেশ খাতির। ভেতরে ঢুকার আগে সরাসরি যুবকটির দিকে তাকায় সে। না। আসলে এদিকে তাকিয়ে নেই সে । তার চোখ আরো উপরে। হয়তো পাঁচ তলার দিকে।
বেতের পুরোনো সোফায় বসে মা তখন আক্ষেপ করছিল- মেয়েটাকে নিয়ে চিন্তায় আছি। যে জামানা পড়ছে। পড়ালেখা আর ক্যা দেখে? আত্মীয়জনকে বলেও রাখছি পাত্র দেখার জন্য। কিন্তু কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। ওর বাবা তো ডায়াবেটিসের রোগী। হার্টেরও সমস্যা আছে। মেয়েটার একটা ব্যবস্থা করতে না পারলে...
অসহায় মানসিকতার নন্দিতার মাকে পেয়ে সুপ্তির মায়ের আত্মতৃপ্তি বলক ওঠা দুধের মতো উথলে পড়ে। উৎকট করে চাছা-ছেলা ভ্রু জোড়া নাচায় একটু। নিম্ন মধ্যবিত্ত জীবনের স্তিমিত ও গতানুগতিক জীবনের স্বাদ থেকে বেরিয়ে আসার জন্যই নন্দিতার মায়ের কাছে আসে সে।
মেয়েকে নিয়ে নন্দিতার মায়ের খেদ তৃপ্তি সহকারে গিলে সে-
আমার সেই চিন্তা নাই। মেয়েটা কত সুন্দর । এখনই কত পাত্রের বাবা-মা জোরাজুরি করছে। সেদিন তো এক পুলিশ অফিসারের মা এসে হাজির। পুলিশটির নাকি ঢাকায় তিনটি বাড়ি আছে। আরেকদিন ওয়াসার কর্মকর্তা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে নিজেই হাজির। কিন্তু সুপ্তির বড়ভাই আর বাবা রাজি না। আমরা চাই আর্মির কর্মকর্তার কাছে বিয়ে দিতে।
একথা ঠিক, সুপ্তির গায়ের রঙ উজ্জ্বল। চেহারাও খারাপ না। কিন্তু তার মার উল্লেখিত এসব লোকের কেউই বিয়ের ঘর না নিয়ে এলেও, সুপ্তির মা সবসময় বাড়াবাড়ি ধরনের মিথ্যা কথা বলে তৃপ্তি পায়। আর নন্দিতার মা সেসব কথা শোনে আরো মোচড়ে পড়ে। রান্না ঘর থেকে এসব শুনতে পায় নন্দিতা। চায়ের পানি বলকের সাথে তার মনটার মধ্যেও দুঃখের বলক ওঠে। ওপাশ থেকে আবার সুপ্তির মার গলা শোনা যায়-
আপনার মেয়েটাও কেমন জানি বলদা বলদা। বাইরে যাওয়ার সময় আটসাট কাপড় পরতে পারে না? দশজনের চোখে না পড়লে বিয়ের ঘর আসব কীভাবে?
সুপ্তির মায়ের একথার প্রতিবাদ না করে মা বলে-
মেয়েটা আমার লক্ষ্মী। রান্না-বান্না থেকে শুরু করে সব কাজই নিপুণভাবে করতে পারে।
তাও মেয়েটা যে স্বামীর আদর পাইব না।
নিজেকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে মা- তা কেন? ভালো মানুষের কাছে বিয়ে হলে ওর গুনের কদর অবশ্যই পাবে।
চায়ের কাপ নিয়ে দুজনের সামনে দাঁড়ালে ওর সম্পর্কিত সব আলাপ বন্ধ থাকে কিছুক্ষণ।
আবার বারান্দায় যায় নন্দিতা। তখনও যুবকেরা আড্ডা দিচ্ছিল। সুপ্তির মায়ের কথা শুনে নন্দিতার মনটা খারাপ হয়ে আছে। গায়ের রঙটা উজ্জ্বল করার জন্য কত কী-ই না করেছে সে। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দীর্ঘ একবছর খালি পেটে কাচা হলুদের রস খেত। কী সে বিশ্রি গন্ধযুক্ত সে জিনিস।
নিজের অন্ধকার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে ও। চারদিকের অন্ধকার ভেদ করে হাঁটতে হাঁটতে সে চলে যায় অজানা দেশে। একটা কথা এখনও তো চালু আছে- যার চোখে যারে লাগে ভালো। ওর বেলাতেও তা ঘটবে না কেন? কে জানে হয়তো ইতিমধ্যেই ওকে ভালোবেসেছে সেই যুবক। তাইতো প্রতিদিন সে মোড়ে এসে দাঁড়ায়। নন্দিতা বারান্দায় গেলে তাকিয়ে দেখেও। যদি নির্জন কোনো জায়গায় দেখা হয় দুজনের তাহলে ওর বুকের মধ্যে নিজেকে সেঁধিয়ে দিয়ে পরম পুলকে চোখ বুঝবে ও। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করেও শেষ হবে না কথা। নদীর স্রোতের মতো বয়ে যাবে ওদের ভালোলাগা ভালোবাসার প্রতিটি ক্ষণ।
সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে বলে তৈরি হচ্ছিল নন্দিতা। এসময় সুপ্তির মা আসে। কাঁদতে কাঁদতে মহিলার চোখ মুখ ফুলে গেছে। এঁটো থালা-বাসন মাজা বাদ দিয়ে নন্দিতার মা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে। তা দেখে সুপ্তির মা বলে-
আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে আপা!
কব্জি জুড়ে লেগে থাকা সাবানপানি আঁচলে মুছতে মুছতে ব্যাকুল হয়ে নন্দিতার মা জানতে চায়-
কেন? কী হইছে?
মেয়েটা শেষে আমাদের মুখে চুনকালি মাখলো! হারামজাদী পালায়ে গেছে।
নন্দিতার মা অবাক হয়ে জানতে চায়-
পালায়ে গেছে? কখন? কার সাথে?
আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বলে সুপ্তির মা-
ওই যে মোড়ে আনোয়ার হারামজাদা দাঁড়িয়ে থাকে তার সাথে।
ডাইনিং টেবিলের এক প্রান্তে হেলান দিয়ে শুনছিল নন্দিতা। আনোয়ার হোসেনের কথা শুনে ওর বুকটা শুকিয়ে যায়। মনের মধ্যে হু হু করে বইতে থাকে বিরহের বাতাস। কষ্টে চোখ ভিজে আসতে চায়।
ছিঃ ছিঃ কী লজ্জার কথা। তা ছেলেটা কী করে?
সুপ্তির বাপ সকালে ওই ছেলের বাড়িতে গেছিল। বস্তিমত বাড়িতে থাকে। ছেলে কিছুই করে না। ওর বড় ভাই ফুটপাতে সিগারেট আর চা বেচে।
কন কী !
শুধু কি তাই? ওই হারামজাদা নাকি বিবাহিত। দেশের বাড়িতে বউ পোলাপান আছে।
একথা শুনার পর দুঃখগুলো নন্দিতার বুক থেকে ধোঁয়া হয়ে বেরিয়ে আসে। কী সাংঘাতিক পরিস্থিতি থেকেই না বেঁচে গেছে ও। আনোয়ার তার সাথে পালাতে বললে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তা করতো নন্দিতা। অথচ ওর দিকে ফিরেই তাকায়নি আনোয়ার।
[email protected]
এইচআর/পিআর