‘ইউএনওর বাসায় চুরির ঘটনা মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়নি’
ঘোড়াঘাটের ইউএনও ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলার পেছনের রহস্য ও এর সঙ্গে জড়িত গডফাদারদের খুঁজে বের করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক।
মঙ্গলবার (৮ সেপ্টেম্বর) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকের পর তিনি এ তথ্য জানান।
কক্সবাজারে মেজর (অব.) সিনহা হত্যা ও ইউএনও ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলার বিষয়ে বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছে- জানতে চাইলে মোজাম্মেল হক বলেন, ‘কক্সবাজারে মেজর (অব.) সিনহা হত্যার তদন্ত যৌথভাবে হচ্ছে। তদন্ত প্রতিবেদন অনুসারে যাতে আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ হয়, দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘একই সঙ্গে ইউএনওর বাসায় চুরির ঘটনা, এটা মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। কী কারণে তার ওপর হামলা হয়েছে? আমরা এর নিন্দা তো করেছি, আরও ইনভেস্টিগেশনের জন্য গোয়েন্দা সংস্থাকে নির্দেশ দিয়েছি, পেছনে আর কী রহস্য রয়েছে। এটার গডফাদার কোথায় বা কারা সেগুলো দেখার জন্য।’
গত ২ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের সরকারি বাসভবনে সন্ত্রাসীদের হামলায় গুরুতর আহত হন ইউএনও ওয়াহিদা খানম ও তার বাবা ওমর আলী। ওয়াহিদা খানমের মাথায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। তাকে প্রথমে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে রংপুরে একটি ক্লিনিকে আইসিইউতে নেয়া হয়। সেখান থেকে ৩ সেপ্টেম্বর দুপুরে হেলিকপ্টারে করে অচেতন ওয়হিদা খানমকে ঢাকায় ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
৩ সেপ্টেম্বর রাতে তার মাথায় অস্ত্রোপচার হয়। ধীরে ধীরে তার অবস্থার উন্নতি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
ওয়াহিদার ওপর হামলার ঘটনায় ইতিমধ্যে তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছেন, চুরির উদ্দেশ্যে ইউএনওর বাড়িতে প্রবেশ করেছিলেন।
বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমেদ ইউএনও ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলা চুরির ঘটনা নয় উল্লেখ করে জানান, এটি পরিকল্পিত আক্রমণ।
নিরাপত্তা দেয়া হবে পুরো উপজেলা কমপ্লেক্সে
মোজাম্মেল হক বলেন, ‘আপনারা শুনেছেন ইতিমধ্যে ইউএনওদের বাসভবনে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে যাতে তাদের রাত্রীকালীন নিরাপত্তা থাকে। আজকে আমরা সংশোধন করে বলেছি, পুরো উপজেলা কমপ্লেক্সে নিরাপত্তা দিতে, কারণ সেখানে আরও অফিসার থাকেন। সেখানে অনেক অফিসারই পরিবার নিয়ে বাস করেন, তাদেরও নিরাপত্তার প্রশ্ন রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে সেখানে কিছু আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ আছে এই এনজিওদের নামে। যাতে রোহিঙ্গারা বিভিন্নভাবে দ্বিধাবিভিক্ত হয়ে মারামারি, কাটাকাটি বা মাদকদ্রব্য ও ক্রাইমে জড়িত হচ্ছে। সেগুলোও নিয়ন্ত্রণের জন্য সিদ্ধান্ত হচ্ছে। অচিরেই ভালোভালে ফ্যান্সিংয়ের (বেড়া) ব্যবস্থা করব এবং ২৪টি টাওয়ার নির্মাণ করা হবে, সেখান থেকে যেন ২৪ ঘণ্টা তাদের কার্যক্রম মনিটর করতে পারি। প্রয়োজনীয় সংখ্যক সিসি ক্যামেরা দিয়ে তাদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করব।’
‘গোযেন্দা সংস্থা কিছু কিছু এনজিওর (উস্কানি দেয়া) নাম বলেছে। আমরা মনে করেছি এটা সম্পূর্ণ নয়, বিক্ষিপ্ত। সুনির্দিষ্টভাবে তাদের কার্যক্রম...ওমুকে খারাপ কাজ করে এক লাইন বলে ছেড়ে দিলে তো হবে না। কী খারাপ কাজটা, কী অন্যায়টা করল- সেটাসহ রিপোর্ট আমরা পরবর্তী সভায় পেশ করার জন্য বলেছি।’
গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কার্যক্রম সমন্বয় করা হবে
মোজাম্মেল হক বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলার বিষয়ে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো স্ব স্ব গোয়েন্দা শাখার প্রধানের কাছে রিপোর্ট জমা দেবে, সেগুলো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কম্পাইলড হবে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বিক্ষিপ্তভাবে কাজ করে। কাজের সমন্বয়ের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হয়েছে, বিক্ষিপ্তভাবে না হয়ে সবগুলো যদি একত্রে বিবেচনায় নেয়া যায় তাহলে প্রতিকার করতে সহজ হয়। সেজন্য সব গোয়েন্দা সংস্থাকে এক ছাতার নিচে আনার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘সেজন্য আমরা একটি কমিটি সাজেস্ট করেছি। সামনাসামনি আলাপ হলে কার কী অভিমত সেগুলো শুনে সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হবে। আমরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দায়িত্ব দিয়েছি। উনি কমিটি গঠন করবেন।’
আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আছে
করোনা মহামারির মধ্যে আইনশৃঙ্খলা নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে মন্ত্রিসভা কমিটির প্রধান বলেন, ‘এ অবস্থায়ও আমরা অত্যন্ত সন্তুষ্ট, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আছে এবং যেহেতু মানুষের আয়-রোজগারের পথ কমে গেছে কাজেই ওই লোকজন হয়তো ক্রাইমের দিকে যাবে, সেটা আল্লার মেহেরবাণীতে প্রধানমন্ত্রীর দিক নির্দেশনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে বলে মনে করি।’
মাদক যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে রয়েছে দাবি করে মোজাম্মেল হক বলেন, ‘এরপরও আমরা এটাকে আরও উন্নত করতে চাই যে, অনেক সময় উচ্চ পর্যায়ের লোকজনও মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। আমরা এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, শুধু আনা নেয়া করে তাদের নয়, যারা তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় তাদের আইডেন্টিফাই করে হাত দিতে হবে। আরও বেশি যাতে মাদকবিরোধী অভিযান চলে সে জন্য বলা হয়েছে।’
অবৈধ বিদেশিদের ক্যাম্পে রাখা হবে
আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভাপতি বলেন, ‘দেশে ৫০০-৭০০ এর বেশি বিদেশি নাগরিক রয়েছেন, যাদের পাসপোর্টের মেয়াদ ও ভিসা নেই। তারা মেয়াদোত্তীর্ণ অবস্থায় দেশে অবস্থান করছেন। এই বিদেশি চক্র টাকা পাচার করা বলেন, অন্যান্য ক্রাইম বলেন- আপনাদের মাধ্যমে মাঝে মাঝে জাতি জানতে পারে তারা এসব ক্রাইম করছে।’
‘এরা বিক্ষিপ্তভাবে এখানে-সেখানে গুলশানে হোটেলে থাকে। পরিপূর্ণ তালিকা না থাকলেও একটা সন্তোষজনক তালিকা পুলিশ বিভাগের কাছে আছে। তাদের সবাইকে নিয়ে একটা ক্যাম্প করতে চাচ্ছি। ক্যাম্পে নিয়ে তাদের রাখা হবে। তাদের স্ব স্ব দেশে পাঠিয়ে দেয়ার জন্য, তারা যদি নিজেদের টিকিট কাটতে সমর্থ্য না হয়, সরকারি পয়সায় টিকিট কেটে তাদের নিজের দেশে পাঠানোর জন্য আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ভিসা নেই এবং যারা ক্রাইমে জড়িত তাদের।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিদেশে টাকা পাচার হচ্ছে মোবাইল বা অনলাইনে, অত্যাধুনিক প্রক্রিয়ায়। সেজন্য এনবিআরকে অনুরোধ করেছি সেখানে (ইউটিউব ও অন্যান্য অনলাইন প্ল্যাটফর্মে) এই বিজ্ঞাপন দেয় কারা, দেশে থেকে দেয় নাকি দেশের বাইরে থেকে দেয়, টাকার উৎস কী?’
‘আপনারা নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন- ইউটিউব, ফেইসবুকে ইত্যাদির মাধ্যমে শুধু সরকারবিরোধী নয়, সরকারের বিরুদ্ধে বলার তো আপনার অধিকার আছে। তাদের বক্তব্য রাষ্ট্রবিরোধী। সাইবার অপরাধগুলো এখন খুব অ্যালার্মিং হয়ে গেছে। সাইবার অপরাধ দমনে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়াতে এবং সোশ্যাল মিডিয়ার হেড কোয়ার্টার এখানে শিফট করার মাধ্যমে মনিটর করব। কোনো কিছু বন্ধ করে দেয়া হবে না, আমরা বন্ধের পক্ষে নয়। সেগুলোর জবাবদিহিতা থাকবে আমরা তার পক্ষে’ বলেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী।
মোজাম্মেল হকের সভাপতিত্বে বৈঠকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জমান খান কামাল, জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস, আইনশঙ্খলা বহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাসহ কমিটির অন্যান্য সদস্যরা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
আরএমএম/এএইচ/এমএস