দক্ষিণ এশিয়ার পরিচ্ছন্নকর্মীদের ঝুঁকি ও ভীতির তথ্য ওয়াটারএইডের
দক্ষিণ এশিয়ার পরিচ্ছন্নকর্মীরা অল্প স্বাস্থ্যসুরক্ষা সরঞ্জাম ও সীমিত হ্যান্ডওয়াশ এবং অন্যান্য জীবাণুমুক্তকরণ সুবিধাহীনতার মধ্যেই কাজ করে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছে ওয়াটারএইড। সংস্থাটির নতুন রিপোর্টে এ তথ্য জানা গেছে।
‘সেফটি অ্যান্ড ওয়েলবিয়িং অফ স্যানিটেশন ওয়ার্কার্স ডিউরিং কোভিড-১৯ ইন সাউথ এশিয়া’ শীর্ষক এই প্রতিবেদনে কোভিড-১৯ মহামারী কিভাবে দক্ষিণ এশিয়ার পরিচ্ছন্নতা ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্মীদের জীবনকে প্রভাবিত করছে সে প্রসঙ্গে আলোকপাত করা হয়েছে।
পরিচ্ছন্নকর্মীরা সমাজের অন্যতম একটি গুরুদায়িত্ব পালন করে থাকেন, যা লকডাউনের সময়ও অব্যাহত ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাদেরকে অধিকাংশ সময়ই স্বল্প বেতনের বিনিময়ে একটি অনিশ্চয়তাপূর্ণ জীবনযাপন করতে হয়, যার সাথে যুক্ত হয় চিরায়ত সামাজিক গোঁড়ামি ও বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি।
এ প্রসঙ্গে এপ্রিলের শেষ থেকে জুনের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় ছয় সপ্তাহব্যাপী সময়ে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও পাকিস্তানে একটি গবেষণা চালানো হয়। পরিচ্ছন্নতা কার্যের বিভিন্ন ধারার সাথে জড়িত কর্মীদের এই গবেষণার আওতায় ইন্টারভিউ করা হয়, যার মধ্যে ছিলেন বর্জ্য সংগ্রহকারী, ঝাড়ুদার, ল্যাট্রিন এবং হাসপাতাল পরিষ্কার কর্মীরা।
কর্মীদের পরিবারের সদস্যদের মাঝে রোগ সংক্রমণ ও স্বাস্থ্যঝুঁকির প্রসঙ্গে উদ্বেগের বিষয়টি চারটি স্টাডির প্রতিটিতেই উঠে এসেছে বলে প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে ইন্টারভিউতে অংশ নেওয়া দশজন কর্মীর আটজনই বলেছেন, তাদের পেশা তাদেরকে উচ্চতর ঝুঁকির সম্মুখীন হতে বাধ্য করেছে।
অধিকাংশ কর্মীর মধ্যেই ঝুঁকি রোধ করতে পার্সোনাল প্রোটেক্টিভ ইক্যুপমেন্ট (পিপিই)-র ব্যবহার প্রসঙ্গে স্পষ্ট ধারণা থাকা সত্ত্বেও এর যথাযথ সরবরাহ ও ব্যবহার ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। কিছু ক্ষেত্রে নিয়োগকারী পক্ষ থেকে পিপিই সরবরাহ করা হলেও এর মাপ, গুণগত মান ও পর্যাপ্ততা প্রসঙ্গে অসঙ্গতি লক্ষ্য করা গেছে।
মাস্ক এবং গ্লাভসের ব্যবহার তুলনামূলকভাবে পর্যাপ্ত দেখা গেলেও অন্যান্য বিশেষায়িত উপকরণ, যেমন অ্যাপ্রন বা গগলসের ক্ষেত্রে সরবরাহ ও ব্যবহার ছিল অপ্রতুল। এমনকি হাসপাতাল পরিষ্কার কর্মীদের মতো উচ্চমাত্রার ঝুঁকিতে থাকা কর্মীদের ক্ষেত্রেও এই অসঙ্গতি লক্ষ্য করা যায়।
নেপালের মোট পরিচ্ছন্নকর্মীদের এক তৃতীয়াংশকে তাদের নিয়োগকারী পক্ষ কোনো পিপিই-র সংস্থান করেনি। ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের কর্মীরাও উষ্ণ আবহাওয়ায় পিপিই পরে কাজ করতে গিয়ে সমস্যা অনুভব করেছেন বলে জানিয়েছেন।
পরিচ্ছন্নকর্মীরা নিজ কর্মক্ষেত্রে নানাপ্রকার ঝুঁকির সম্মুখীন হয়ে থাকেন, এমনকি বিভিন্নভাবে আহত বা নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটে থাকে। কোভিড-১৯ মহামারি তাদের এই পেশাগত ঝুঁকিকে আরও বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে, এবং তাদের অনেককেই সীমিত স্বাস্থ্যসুরক্ষার মাঝে প্রায় কোনো স্পষ্ট দিক-নির্দেশনা ছাড়াই কাজ চালিয়ে যেতে বাধ্য করেছে।
খুলনা থেকে একজন পরিচ্ছন্নকর্মী বলেন, ‘আমার এবং আমার মতো অন্যান্য পরিচ্ছন্নকর্মীদের কারণেই সমাজের মানুষেরা লকডাউনের সময়েও বর্জ্যনিষ্কাশন প্রসঙ্গে কোনো মাথাব্যাথা ছাড়াই নিশ্চিন্তে দিনাতিপাত করতে পেরেছেন। আমরা আমাদের কাজগুলো না করে গেলে মানুষ তাদের উচ্ছিষ্ট বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে হিমশিম খেয়ে পড়তেন। জনসাধারণকে স্বস্তি দেওয়ার জন্যই এতটা ঝুঁকি নিয়ে আমরা কাজ করে যাই। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, আমাদের এই ত্যাগ অধিকাংশ মানুষের কাছেই মূল্যহীন।’
সাবান ও পানির পর্যাপ্ততার ওপর ভিত্তি করে নিয়মিত হাত ধোয়ার চর্চাটিও ক্ষেত্র বিশেষে ভিন্ন ভিন্ন চিত্রের জন্ম দিয়েছে। ভারতে অধিকাংশ কর্মীই একেকটি কর্মদিবসে অন্তত দুইবার হাত ধোয়া বা স্যানিটাইজ করার কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ৪০ শতাংশ কর্মীই জানিয়েছেন যে, তাদের কর্মস্থলে কোনো নির্ধারিত হ্যান্ড ওয়াশিং স্টেশন নেই এবং প্রায়শই কোভিড-১৯ সংক্রান্ত ক্রান্তিকালেও সকলের মাঝে হাতধোয়ার চর্চাটি নিয়মিত ছিল না।
চারটি দেশের অসংখ্য পরিচ্ছন্নকর্মী তাদের জীবিকা সংস্থানের ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। অন্তত অর্ধেক অংশগ্রহণকারী তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয়তা মেটানোর ক্ষেত্রে হিমশিম খাচ্ছেন বলে জানান। আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে সমস্যাকে আরও প্রকট করে তোলে খাদ্য ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা সরঞ্জামের মূল্যবৃদ্ধি। অল্প কিছুসংখ্যক কর্মী বাদে অধিকাংশ পরিচ্ছন্নকর্মীরই সামাজিক ঝুঁকি নিরসন ও জরুরি সেবা প্রসঙ্গে ছিল না উল্লেখ্যযোগ্য কোনো প্রচেষ্টা।
ভানিতা সুনেজা, রিজিওনাল অ্যাডভোকেসি ম্যানেজার– সাউথ এশিয়া, ওয়াটারএইড, বলেন, ‘এই মহামারিকালেও কাজ করে যাওয়া ছাড়া পরিচ্ছন্নকর্মীদের আর খুব বেশি কিছু করার নেই। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা এই কাজটি করে যাচ্ছেন যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা বা কোনো বিশেষ পুরস্কারের প্রত্যাশা ছাড়াই। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সরকারের উচিত ঝুঁকির মাঝে কাজ করে যাওয়া এই পরিচ্ছন্নকর্মীদেরকে একটি নিরাপত্তা বলয়ের আওতায় নিয়ে আসা, যার ভেতরে হেলথ ইন্স্যুরেন্স, গাইডলাইন ও ট্রেনিং সুবিধা থাকবে। কেবলমাত্র যথাযোগ্য স্বীকৃতি এবং নিরাপত্তার মাধ্যমেই এই স্বার্থহীন মানুষগুলো সুস্থ থেকে সমাজের প্রতি তাদের দায়িত্ব পালন করে যেতে পারবেন।’
এই প্রতিবেদনটি স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করে যে, বিদ্যমান ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে পরিচ্ছন্নকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অতিসত্ত্বর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। পরিচ্ছন্নকর্মীদের কর্ম পরিবেশ ও জীবনযাপনের অবস্থার দীর্ঘমেয়াদি উত্তরণ ঘটিয়ে বহু বছর ধরে টিকে থাকা সামাজিক গোঁড়ামি থেকে বেরিয়ে আসতেও প্রয়োজন একাগ্র প্রচেষ্টার।
এসএইচএস/এমকেএইচ