পিতার কাঁধে সন্তানের লাশের বোঝা
পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ নাকি পৃথিবীতে সবচেয়ে ভারীবস্তু। অধ্যাপক, চিন্তাবিদ লেখক আবুল কাসেম ফজলুল হক এখন কী করে এই ভার বহন করবেন? কী তার অপরাধ? তার সন্তানেরই বা কী দোষ যে এভাবে একদল হিংস্র হায়েনার চাপাতির নিচে তার জীবন উৎসর্গ করতে হল। কী জবাব হতে পারে এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের।
ফয়সাল আরেফিন দীপন ছিলেন জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী। শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে তিন তলায় এই প্রকাশনীর দোকান। সেখানেই গতকাল বিকেলে পৈশাচিক কায়দায় হত্যা করা হয় তাকে। একই কায়দায় হামলা করা হয় লাল মাটিয়ায় শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর মালিক আহমেদুর চৌধুরীর ওপর। তার সঙ্গে থাকা কবি তারেক রহিম ও রণদীপম বসুকেও নির্মমভাবে কোপানো হয়। দুইটি ঘটনায়ই বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। পরে পুলিশ ও স্বজনরা তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। বইমেলা থেকে ফেরার পথে খুন হওয়া লেখক অভিজিত রায়ের বইয়ের প্রকাশক ছিলেন দীপন। শুদ্ধস্বর থেকে আহমেদুর চৌধুরীও তার বই বের করেছিলেন। অভিজিতের বই প্রকাশ করাই এদের অপরাধ। সেকারণেই নির্মম জিঘাংসার শিকার হয়েছেন তারা। অকস্মাৎ ঘাতক এসে দরজায় কড়া নাড়েনি। হুমকি ছিল আগে থেকেই। দুই প্রকাশনীর মালিক জিডিও করেছিলেন থানায়। কিন্তু পুলিশ তাদের ঘাতকের রোষ থেকে বাঁচাতে পারেনি।
যেমন পারছে না অপরাপর ব্লগার হত্যার খুনিদের ধরতে। বিচারহীনতাই ক্রমাগত এই মৃত্যুর মিছিলকে দীর্ঘায়িত করছে। এই হত্যাকাণ্ডের পরও নিয়মমাফিক বিবৃতি এসেছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পক্ষ থেকে। আসামীদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার কথাও উচ্চারিত হয়েছে দৃঢ়তার সাথে। কিন্তু সেই আশ্বাস বাণীতে আশ্বস্ত হওয়ার মতো আদৌ কি কোনো উপাদান আছে?
একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে যেখানে একটি সরকার আছে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আছে সেখানে ঘাতকচক্র দিনের পর দিন সীমাহীন ঔদ্ধত্য দেখিয়েই যাচ্ছে। এই অপশক্তির উল্লম্ফনের উৎস কোথায়?
দুইজন বিদেশি নাগরিক হত্যার পর নিরাপত্তাহীনতার উদ্বেগের মধ্যেই আবার খোদ রাজধানীতে দিনে দুপুরে জনাকীর্ণ এলাকায় খুনিরা তাদের মিশন সফল করে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যেতে পারছে। দেশটা কি খুনিদের অভয়ারণ্য হয়ে গেল? মানুষজন যদি নিজ বাড়িতেই নিরাপদে না থাকে তাহলে রাষ্ট্র,সরকার এগুলো কী জন্য? সরকারের অন্যতম সাংবিধানিক দায়িত্ব হচ্ছে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। একের পর এক হত্যাকাণ্ডের পর স্বভাবতই প্রশ্ন জাগছে সরকার তাহলে কী করছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাজই বা কী।
লেখক-ব্লগার-প্রকাশক হত্যা কোনো সাধারণ খুন-খারাবির ব্যাপার নয়। কোনো একটি মহল বিশেষ আদর্শ তাড়িত হয়ে এসব সিরিজ হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। এটা স্পষ্টতই মুক্তচিন্তা, ও বাকস্বাধীনতার ওপর চরম আঘাত। এভাবে চলতে থাকলে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে সেটা ভাবা যায়? আর এ পর্যন্ত যা হয়েছে সেটাও বা কম কীসের। গত ৩২ মাসে ৬ জন ব্লগারকে খুন করা হয়েছে। একদিকে বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য যুদ্ধাপরাধের বিচার চলছে, আবার সেই সরকারের সময়েই মুক্তচিন্তার মানুষজনকে বেছে বেছে হত্যা করা হচ্ছে- এই বৈপরীত্য মেনে নেয়া যায় না।
মানুষের হতাশা কোন পর্যায়ে গেলে একজন সন্তানহারা পিতা বলতে পারেন ‘আমি কোনো বিচার চাই না।’ সেটি ভাবতে হবে। অভিজিত রায়ের পিতা অধ্যাপক অজয় রায়কেও বইতে হচ্ছে সন্তান হারানোর বেদনা।
আমরা এই জঘন্য হত্যা এবং হত্যা চেষ্টার তীব্র নিন্দা জানাই। ঘাতকদের গ্রেপ্তারে পুলিশ সক্ষমতা দেখাবে বলেও আস্থা রাখতে চাই। এখন সরকারকে সেটা করে দেখাতে হবে। কোনো ছলছুতোয় আখেরে কাজ হবে না। কারণ নগর পুড়লে দেবালয়ও কিন্তু এড়ায় না।
এইচআর/এমএস