২১ আগস্ট যা ঘটেছিল
দিনটি ছিল শনিবার। সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও তখনকার বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনা। বিকেল ৫টা ২২মিনিট বক্তৃতা শেষে ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ উচ্চারণ করে শেখ হাসিনা তার হাতে থাকা একটি কাগজ ভাঁজ করতে করতে এগুচ্ছিলেন মঞ্চ থেকে নামার সিঁড়ির দিকে। সঙ্গে সঙ্গে একটি গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটে।
গ্রেনেডটি মঞ্চের পাশে রাস্তার উপর পড়ে বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। এরপর একে একে আরও ১৩টি গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়। মুহূর্তের মধ্যে পুরো এলাকা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। আতঙ্কে মানুষ দিগ্বিদিক ছোটাছুটি শুরু করে। মুহূর্তের মধ্যে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয় বঙ্গবন্ধু এভিনিউ।
সেদিন সন্ত্রাস ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সমাবেশ ও সমাবেশের পর বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করা হয়। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আয়োজন করা এই সমাবেশে একের পর এক গ্রেনেডের বিস্ফোরণে এবং স্প্লিন্টারের আঘাতে মঞ্চের নিচে রাস্তার উপরে বসা বেগম আইভি রহমানসহ অসংখ্য মানুষ লুটিয়ে পড়েন। পরিস্থিতি বেগতিক বুঝতে পেরে মঞ্চে উপস্থিত ঢাকার তৎকালীন মেয়র মোহাম্মদ হানিফ এবং শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত দেহরক্ষী তাত্ক্ষণিকভাবে এক মানবঢাল তৈরি করে শেখ হাসিনাকে গ্রেনেডের হাত থেকে রক্ষা করেন।
ওইদিন ঘটনাস্থলেই ১৬ জন নিহত এবং চার শতাধিক আহত হন। পরে এই ঘটনায় দলের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক ও জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ মোট ২২ জন নিহত হন। মেয়র হানিফের মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হওয়ায় অস্ত্রোপচার করার কথা থাকলেও গ্রেনেডের স্প্লিন্টার শরীরে থাকায় তা আর করা সম্ভব হয়নি। পরে তিনি ব্যাংককের একটি হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় মারা যান।
গ্রেনেড হামলার সময় শেখ হাসিনার সঙ্গে মঞ্চে ছিলেন জিল্লুর রহমান (সাবেক রাষ্ট্রপতি), আমির হোসেন আমু, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, আবদুল জলিল, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, কাজী জাফরউল্লাহ, মোহাম্মদ হানিফ ও মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াসহ আরও কয়েকজন নেতা। আর ট্রাকের পাশেই নিচে ছিলেন ওবায়দুল কাদের, সাবের হোসেন চৌধুরীসহ দলের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।
প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ডাকা শান্তিপূর্ণ একটি সমাবেশে গ্রেনেড হামলার পর মুহূর্তেই পাল্টে যায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউ ও তৎসংলগ্ন এলাকার দৃশ্য। পুরো বঙ্গবন্ধু এভিনিউ রক্তগঙ্গায় পরিণত হয়। ছেঁড়া স্যান্ডেল, জুতা, পড়ে থাকা ব্যানার, প্ল্যাকার্ডে রক্ত, পতাকার সঙ্গে এখানে-সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে নারী-পুরুষের নিথর দেহ। কেউ গ্রেনেড বিস্ফোরণে পুড়ে হাত-পা বাঁকা হয়ে মরে আছেন, কেউবা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন।
গ্রেনেড হামলার সময় শেখ হাসিনার সঙ্গে থাকা দেহরক্ষীরা কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে। এ অবস্থায় মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াসহ দেহরক্ষীরা তাকে ধরে ট্রাক থেকে দ্রুত নামিয়ে গাড়িতে তুলে দেন। স্টেডিয়ামের দিক হতে দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে তাকে সরিয়ে নেয়া হয়। শেখ হাসিনা যখন ঘটনাস্থল ত্যাগ করছিলেন তখনও একই দিক থেকে কয়েক সেকেন্ড বিরতি দিয়ে গ্রেনেড এসে ঘটনাস্থলে বিস্ফোরিত হতে থাকে। একই সঙ্গে চলছিল গুলির শব্দ। এসব গুলি-গ্রেনেড ঠিক কোথা থেকে ছোড়া হচ্ছিল তা বোঝা যাচ্ছিল না। শেখ হাসিনার বাসভবন ধানমন্ডির সুধা সদনে গিয়ে তাকে বহনকারী মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়ির সামনে-পেছনে গ্রেনেড ও গুলির আঘাতের চিহ্ন দেখা যায়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা আরও জানান, কী ঘটছে কিছুই বুঝতে না পেরে অনেক নেতাকর্মী এ সময় ছুটে দলীয় কার্যালয়ের ভেতরে যান। আহতদের মধ্যেও অনেককে ধরে ভেতরে নেয়া হয়। অনেককে দেখা যায় পথে রক্তাক্ত অবস্থায় ছুটোছুটি করতে। গ্রেনেড বিস্ফোরণের ঘটনায় এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আহতদের হাসপাতালে পাঠাতে বিড়ম্বনায় পড়তে হয় দলীয় নেতাকর্মীদের। এ অবস্থায় রিকশা, অ্যাম্বুলেন্স, প্রাইভেট কার, বেবি ট্যাক্সি ও রিকশায় করে আহতদের প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। অনেককে রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে থেকে সাহায্যের জন্য আকুতি জানাতে দেখা গেছে। এদের মধ্যে বেশ কয়েকজন নারীও ছিলেন।
বিস্ফোরণের প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠে আওয়ামী লীগের কর্মীরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। একদিকে যখন আহতদের উদ্ধার চলছিল, আরেকদিকে বিক্ষুব্ধ কর্মীরা রাস্তায় যানবাহনে হামলা করছিলেন। বৃষ্টির মতো ইট-পাটকেল ছুড়ে ভাঙচুর করা হয় বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের সিটি ভবনসহ আশপাশের আরও কয়েকটি ভবনের জানালা-দরজা। বাস, মিনিবাস, গাড়ি সামনে যা পাচ্ছিলেন তাই ভাঙতে থাকেন তারা। ২০-২৫টি যানবাহনে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। এ সময় শেখ হাসিনার নিরাপত্তাকর্মী বাদে ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত কোনো পুলিশ ছিল না। পুলিশ ছিল স্টেডিয়াম প্রান্ত এবং গোলাপ শাহ মাজারের কাছে। বিস্ফোরণের শব্দ শুনে দু-একটি এলাকা থেকে পুলিশ ছুটে আসে এবং ঘটনাস্থল লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে বিক্ষুব্ধ কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করতে থাকে।
গ্রেনেড হামলায় নিহত ও আহতদের উদ্ধার করতে গিয়ে উদ্ধারকারীরাও আহতদের শরীর থেকে বের হওয়া রক্তে ভিজে একাকার হয়ে যান। ফলে পাশে দাঁড়িয়েও শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছিল না কে আহত আর কে উদ্ধারকর্মী। আহতদের চিত্কার, উদ্ধারকর্মীদের হইচই আর বিক্ষোভকারীদের স্লোগানের শব্দে মিশে যাচ্ছিল অ্যাম্বুলেন্স আর পুলিশের গাড়ির সাইরেনের শব্দ। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা যখন উদ্ধার কাজ চালাচ্ছিলেন এবং স্লোগান দিচ্ছিলেন তখন উল্টো পুলিশ তাদের লক্ষ্য করে টিয়ারগ্যাস ছুঁড়ে ছত্রভঙ্গ করে দেন।
ঘটনার পর থেকে রাত যত গভীর হচ্ছিল, পুরো ঢাকা শহরে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। গ্রেনেড হামলার পরই মহানগর পুলিশ সদর দফতরের পক্ষ থেকে নগরীর ২২টি থানা এলাকাতেই টহল ব্যবস্থা আরও জোরালো করার জন্য মাঠপর্যায়ের পুলিশকে সতর্ক থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়। এরপরই শুরু হয় নগরীর অলিগলিতে যানবাহন তল্লাশি। অনেক গুরুত্বপূর্ণ সড়ক এবং স্পর্শকাতর স্থাপনার সামনে অতিরিক্তি পুলিশ মোতায়েন করা হয়। এসব এলাকায় বিডিআর টহলও জোরদার করা হয়।
গ্রেনেড হামলা থেকে কোনোভাবে বেঁচে গেলেও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা যেন প্রাণ নিয়ে ফিরতে না পারেন তার সব চেষ্টাই করেছিল হামলাকারীরা। তার গাড়ির কাঁচে কমপক্ষে সাতটি বুলেটের আঘাতের দাগ, গ্রেনেড ছুড়ে মারার চিহ্ন ও বুলেটের আঘাতে পাংচার হয়ে যাওয়া গাড়ির দুটি চাকা সেটাই প্রমাণ করে। সুধা সদনে শেখ হাসিনার বাসভবনে গাড়িটি দেখিয়ে দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ও দলীয় সভাপতির রাজনৈতিক সচিব সাবের হোসেন চৌধুরী সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। তিন স্তরের বুলেট নিরোধক ব্যবস্থা সম্পন্ন মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়িটিই শেখ হাসিনার প্রাণ বাঁচিয়েছে।
গ্রেনেড হামলার পর থেকে আওয়ামী লীগ প্রতি বছরই এই দিনটি বিশেষভাবে নানা কর্মসূচির মাধ্যমে পালন করে আসছে। বৃহস্পতিবার (২০ আগস্ট) দলের এক বিবৃতিতে বলা হয়, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের নেতৃত্বাধীন রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সহযোগিতায় রাজনৈতিক সমাবেশে এ ধরনের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ পৃথিবীর ইতিহাসে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। সেই ভয়াল দিনটি বাঙালি জাতি কোনো দিন ভুলবে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত বাংলাদেশের জনগণ ২১ আগস্ট দিনটিকে ২০০৪ সালের পর থেকে নারকীয় গ্রেনেড হামলার প্রতিবাদে ও হতাহতদের স্মরণে সন্ত্রাস এবং জঙ্গিবাদবিরোধী নানা কর্মসূচি পালন করে আসছে। প্রতিবারের ন্যায় এবারও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
এফএইচএস/এমএসএইচ/পিআর