সাগরের ‘রাজা` ৪১ দস্যু বাহিনী
সমুদ্রসীমা বিজয় হলেও এর সুফল পাচ্ছে না জেলেরা। বঙ্গোপসাগরে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিবর্তে রাজত্ব করছে জলদস্যুরা। বর্তমানে বঙ্গোপসাগর জুড়ে ৪১টি জলদস্যু বাহিনী রাজত্ব করে চলেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এদের হাতে নিয়মিত নিগৃহীত হচ্ছে জেলেরা। চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছে ট্রলার মালিকরাও। এ সকল কারণে জীবনবাজি রেখে সাগর থেকে মাছ আহরণের পেশা ত্যাগ করছেন অনেকেই।
জেলা ফিশিং ট্রলার মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মাস্টার মোস্তাক আহমদ বলেন, আমরা সরকারকে কর দিয়ে লাইসেন্স নিয়ে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরি। কিন্তু এই লাইসেন্স বঙ্গোপসাগরে অকার্যকর। সাগরে নিরাপদে মাছ ধরতে হলে জলদস্যুদের কাছ থেকেও লাইসেন্স নিতে হয়। তবে একটি গ্রুপের লাইসেন্স নিলে হয় না। নিতে হয় ৪১টি জলদস্যু বাহিনীর লাইসেন্স। কারণ তারা পুরো বঙ্গোপসাগরকে ৪১টি ভাগে বিভক্ত করে নির্ধারিত সীমান্তে চালাচ্ছে রামরাজত্ব।
তিনি আরো বলেন, এদের লাইসেন্স না নিলে সাগরে ট্রলার ডাকাতি, মাঝিমাল্লা অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায়সহ নানাভাবে জেলেদের হয়রানি করা হচ্ছে। এমনকি জেলেদের গুলি করে খুনও করা হয়। গত এক বছরে বঙ্গোপসাগরে ৬৩ মাঝিমাল্লাসহ ২১ ফিশিংবোট অপহরণ হয়েছে। ১৭ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ফিরেছে ৬৩ মাঝিমাল্লা। এছাড়া গত ৫ বছরে জলদস্যুদের হাতে ২ শতাধিক মাঝি-মাল্লা প্রাণ হারিয়েছে।
জেলা ফিশিংবোট মালিক সমিতির সভাপতি মুজিবুর রহমান জানান, ডাকাতির কারণে জেলেরা সাগরে মাছ শিকারে যেতে ভয় পাচ্ছেন। সংঘবদ্ধ দস্যুরা প্রায়ই সাগরে ডাকাতি, লুটপাট ও অপহরণ চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ডাকাতি বন্ধে প্রশাসনের সহযোগিতা চাইলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।
একই তথ্য জানান কক্সবাজার শহরের কুতুবদিয়াপাড়ার জেলে মোহাম্মদ আলী ও নূনিয়ারচড়ার জেলে নুরুল আমিন। তারা জানান, সাগর এখন জেলেদের কাছে মোটেই নিরাপদ নয়। সাগর মানেই যেন জলদস্যুদের রাজ্য।
জেলা ফিশিংবোট মালিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, বঙ্গোপসাগরে রাজত্বকারী ৪১টি জলদস্যু বাহিনীর একটি তালিকা সম্প্রতি সমিতির পক্ষ থেকে প্রশাসনকে দেয়া হয়েছে। তালিকা মতে সাগরে রাজত্ব চালাচ্ছে সোনাদিয়া এলাকায় দুর্ধর্ষ জলদস্যু জাম্বু বাহিনী, সরওয়ার বতইল্যা বাহিনী, জলদস্যু সম্রাট নাগু মেম্বারের ছেলে রাকিব বাহিনী, মো. ছমদের ছেলে জাহাঙ্গীরের বাহিনী, বদি আলমের ছেলে আঞ্জু মিয়ার বাহিনী, এখলাস মিয়ার ছেলে মকসুদ বাহিনী, নুরুল ইসলামের ছেলে বক্কর বাহিনী, ফররুখ আহমদের ছেলে রুহুল আমিন বাহিনী, এখলাছ মিয়ার ছেলে মোকাররম জাম্বুর বাহিনী, কালা মিয়ার ছেলে শফির বাহিনী, একে ফজলুল হকের ছেলে সাইফুলের বাহিনী, মোজাফফর আহমদের ছেলে মোস্তফার বাহিনী, আলীর ছেলে সুমনের বাহিনী, বদি আলমের ছেলে (আঞ্জুর ভাই) নাগু-২ বাহিনী, শফিক বাহিনী, মৃত কাসিম আলীর ছেলে সিরাজ বাহিনী (বর্তমানে শহরের চরপাড়ার বাসিন্দা), শহরের নুনিয়ারছড়ার নজরুল ইসলামের ছেলে ফারুক বাহিনী, মহেশখালীর ঘটিভাঙার আব্দুর রহমানের ছেলে আব্দুল মোনাফ বাহিনী, কালারমারচড়ার শীর্ষ সন্ত্রাসী জাহাঙ্গীর বাহিনী।
এছাড়া পূর্ব ঘোনারপাড়ার মোজাহের মিয়ার ছেলে আব্দুস সবুর বাহিনী ও আব্দুল গফুর বাহিনী, পুটিবিলার ইউসুফ আলীর ছেলে সামশুল মাঝি বাহিনী, মাতারবাড়ীর শিমুল বাহিনীর প্রধান শিমুল বাহিনী, রাজঘাটের জয়নাল প্রকাশ জয়নাল ডাকাত বাহিনী, কুতুবদিয়ার রমিজ ডাকাতের ভাই ইউনুছের বাহিনী, কাউছার বাহিনী, দিদার প্রকাশ কানন দিদার বাহিনী, আনোয়ার পাশার ছেলে সাদ্দাম বাহিনী, রহমত আলীর ছেলে আবুল কালাম বাহিনী, দক্ষিণ ধুরং এর ডাকাত সর্দার বাদল বাহিনী, উত্তর ধুরং এর সাহেদ বাহিনী, এখলাস মিয়ার ছেলে মকসুদ বাহিনী, বলীঘাটের বাদশা বাহিনী, লেমসীখালীর রুহুল কাদের বাহিনী, ছালেহ আহমদ বাহিনী, দরবারঘাটের রুবেল বাহিনী, চুলাপাড়ার আবুল কাসেম আবুইয়া বাহিনী, পেকুয়ার রাজাখালীর সেলিম বাহিনী, চট্টগ্রামের বাঁশখালীর বাসিন্না ডাকাত বাহিনী, রবি বাহিনী ও কর্ণফুলীর ইয়াছিনের ছেলে আহমদ নবী বাহিনী।
এ বিষয়ে কক্সবাজার কোস্টগার্ডের কন্টিজেন্ট কমান্ডার নান্নু মিয়া জানান, পর্যাপ্ত জনবল ও সরঞ্জামাদির অভাবে স্থলভাগ থেকে ৭ কিলোমিটারের বাইরে তারা যেতে পারেন না। সম্বল বলতে আছে একটি মাত্র কাঠের বোট। যেটি দিয়ে সাগরে অভিযানে নামা অনেকটা দুরুহ ব্যাপার।
এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন জানান, দস্যুতা রোধে গভীর সাগরে নৌ-বাহিনী, কোস্টগার্ড ও পুলিশের সমন্বয়ে যৌথ অপারেশনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এসএস/এমএস