করোনায় বেড়েছে বাল্যবিয়ে, লাগাম টানতে দরকার আইনের প্রয়োগ
রাজধানী ঢাকার বংশালের রাজিয়া (ছদ্মনাম) স্থানীয় একটি স্কুলে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। বাবা চায়ের দোকানি। করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার পর স্কুল বন্ধ হয়ে গেলে, বাসার মধ্যেই দিন কাটতে থাকে রাজিয়ার। দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় তার বাবা জোর করে বিয়ে দিয়ে দেন। বিয়ের পর রাজিয়ার কিছু শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়।
সম্প্রতি কথা হয় রাজিয়ার বাবা সিদ্দিকের সঙ্গে। তিনি বলেন, করোনার কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় মেয়ে পড়ালেখা করতো না। সারাক্ষণ টিভি দেখতো অথবা মোবাইলে গেম খেলতো। তাই বিয়ে দিয়েছেন। ওর মা অনেক নিষেধ করেছে শুনিনি। এখন মেয়ের অবস্থা খুব ভালো নয়। আমরা গরিব মানুষ। মেয়ের চিকিৎসা করাতে হিমশিম খাচ্ছি। আমার মতো কেউ যেন এমন ভুল না করে।
রাজিয়ার মতো বাল্যবিয়ের শিকার ঠাকুরগাঁওয়ের জগন্নাতপুর ইউনিয়নের কুমিল্লাহাড়ির আলেয়া (ছন্মনাম)। বিয়ের বয়স হওয়ার আগেই সপ্তম শ্রেণিপড়ুয়া এই শিশুকন্যাকে বিয়ে দেন তার বাবা-মা।
এ বিষয়ে আলেয়ার বাবা হামিদ আলী বলেন, স্কুল বন্ধ, মেয়ের পড়ালেখাও বন্ধ। বাড়িতে আর কতো দিন বসে থাকবে। আমরা খেটে খাওয়া মানুষ। আরও দুটি মেয়ে আছে আমার। সংসারের এতো খরচ চালাতে পারছি না। তাই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি।
মেয়ে বিয়ে দেওয়ার সময় কেউ বাধা দেয়নি? এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, প্রথমে একটু বাধা এসেছিল। মেম্বারকে ম্যানেজ করে বিয়ে দিয়েছি। সবকিছু আল্লাহর রহমতে ঠিকঠাকভাবে সম্পন্ন হয়েছে। মেয়ে আমার সুখে আছে। এখন ঘরে থাকা দুই মেয়েকে বিয়ে দিতে পারলে শান্তি পাই।
এ বিষয়ে ওই এলাকার ইউপি মেম্বার শামছুল হক চৈতু’র সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমাদের গ্রামে যাতে কোনো বাল্যবিয়ে না হয়, সেজন্য আমরা বেশ তৎপর। আমার জানামতে এখানে কোনো বাল্যবিয়ে হয়নি। তবে করোনার কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় অনেকেই ঘরে বসে সময় কাটাচ্ছেন। অনেকের কাজ নেই। আমরা তাদের সাধ্যমতো সাহায্য করার চেষ্টা করছি।
করোনাভাইরাসের প্রকোপের পরিপ্রেক্ষিতে অনেক অভিভাবক কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন। কাজ না থাকায় অনেকের ঘরেই অভাব। সামাজিক নিরাপত্তার বিষয় চিন্তা করে অনেক বাবা-মা কন্যাশিশুটি নিজের কাছে রাখতে অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। এ পরিস্থিতিতে রাজিয়া ও আলেয়ার বাবার মতো গ্রাম ও শহরে অনেক অভিভাবক তাদের কন্যাশিশুকে লুকিয়ে বিয়ে দিচ্ছেন। ফলে দেশে ব্যাপক হারে বেড়েছে বাল্যবিয়ে।
করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে গত ক’মাসে দেশে বাল্যবিয়ের হার স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক বেড়েছে বলে সাম্প্রতিক এক জরিপে উঠে এসেছে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের (এমজেএফ) এক জরিপে উঠে এসেছে, জুন মাসে ৪৬২টি কন্যাশিশু বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ২০৭টি বাল্যবিয়ে বন্ধ করা গেছে। তার আগের মে মাসেও ১৭০টি বাল্যবিয়ে হয়। অবশ্য বন্ধ করা গেছে ২৩৩টি।
বাল্যবিয়ে রোধে ২০১৭ সালে একটি আইন পাস হয়েছে। ওই আইনে বলা হয়, কোনো নারী ১৮ বছরের আগে এবং কোনো পুরুষ ২১ বছরের আগে যদি বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন, তাহলে তাকে দুই বছর কারাভোগ করতে হবে। যারা বিয়ে সম্পন্ন করবেন তাদেরও একই শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।
এমজেএফের জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, যেহারে বাল্যবিয়ে বাড়ছে, তাতে বিদ্যমান আইনের সঠিক প্রয়োগ দরকার। তাতেই বাল্যবিয়ে কমবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জরিপের তথ্য তুলে ধরে এমজেএফ’র নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, ইউনিসেফের তথ্যে উঠে এসেছে, এদেশে ৫৯ শতাংশ মেয়ের বয়স ১৮ বছর হওয়ার আগেই বিয়ে হয়। ২২ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয় ১৫ বছরের আগে। বাল্যবিয়ের দিক দিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ।
তিনি বলেন, জুন মাসে দেশের ৫৩ জেলায় মোট ১২ হাজার ৭৪০ জন নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। মে মাসে এই সংখ্যা ছিল ১৩ হাজার ৪৯৪। জুনে নির্যাতনের শিকার নারীদের মধ্যে তিন হাজার ৩৩২ জন নারী ও শিশু আগে কখনোই নির্যাতিত হয়নি। জুনের শুরুতে বেড়েছে শিশু নির্যাতন। শিশুরা তাদের বাবা-মায়ের হাতেই নির্যাতনের শিকার। গৃহবন্দি থাকার কারণে এমন নির্যাতন বেড়েছে। জুনে ৫৩ জেলায় মোট ৫৭ হাজার ৭০৪ জন নারী ও শিশুর সঙ্গে কথা বলে এই জরিপ করা হয়।
শাহীন আনাম আরও বলেন, সহিংসতার শিকার শিশু ও নারীদের এমজেএফের সহযোগী সংগঠনগুলোর মাধ্যমে কাউন্সেলিং, ফলোআপ এবং সেবাপ্রদানকারী সংস্থা, স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ সহায়তা, চিকিৎসা ও আইনি সহায়তা দেয়া হয়েছে। এছাড়া সরকারের প্রতি স্থানীয় সরকার পর্যায়ে বিশেষ সার্কুলার দিয়ে জরুরি ভিত্তিতে নারীর প্রতি সহিংসতা ও বাল্যবিয়ে বন্ধ করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
তিনি জানান, ২০১৮-২০৩০ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে নিরোধ সংক্রান্ত ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যান বাস্তবায়নে এবং করোনার কারণে কন্যাশিশু ও কিশোরী মেয়েদের সামাজিক নিরাপত্তা বিধানে চলতি অর্থবছর কোনো নির্দিষ্ট বরাদ্দ রাখা হয়নি, যদিও বাংলাদেশ সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে এবং জোর করে বিয়ে বন্ধ করার ব্যাপারে অঙ্গীকারবদ্ধ।
শাহীন আনাম আরও বলেন, সরকার কিশোরীদের বিদ্যালয়ে যে অর্থ প্রণোদনা দেয়, সে কারণে বাবা-মা কিশোরীদের বিদ্যালয়ে পাঠান। এটা অনেকাংশে বোঝা যাচ্ছে প্রণোদনা বন্ধ। তাই খাবারের সমস্যার সমাধান করার জন্য বাবা-মা মেয়েকে বিয়ে দেওয়াটাই চূড়ান্ত সমাধান মনে করছেন।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সরকার ও ব্যক্তি সচেতনতায় এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগে এই বাল্যবিয়ে প্রথা বন্ধ হতে পারে।
বাল্যবিয়ের শাস্তি
বাল্যবিয়ে নিরোধ আইনের ৭ (১) ধারায় বলা হয়েছে, প্রাপ্তবয়স্ক কোনো নারী বা পুরুষ বাল্যবিয়ে করলে তা হবে একটি অপরাধ। এজন্য তিনি সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। অর্থদণ্ডের টাকা না দিলে তাকে আরও তিন মাস কারাভোগ করতে হবে।
বাল্যবিয়ে নিরোধ আইনের ৭ (২) ধারায় বলা হয়েছে, অপ্রাপ্ত বয়স্ক কোনো নারী বা পুরুষ বাল্যবিয়ে করলে সে এক মাসের আটকাদেশ বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।
পিতা-মাতাসহ অন্যান্য ব্যক্তির শাস্তি
বাল্যবিয়ে নিরোধ আইনের ৭ ধারায় বলা হয়েছে, পিতা-মাতা, অভিভাবক অথবা অন্য কোনো ব্যক্তি আইনগতভাবে বা আইনবহির্ভূতভাবে কোনো অপ্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে বাল্যবিয়ে সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে কোনো কাজ করলে অথবা করার অনুমতি বা নির্দেশ প্রদান করলে অথবা স্বীয় অবহেলার কারণে বিয়েটি বন্ধ করতে ব্যর্থ হলে তা হবে একটি অপরাধ। সেজন্য তিনি সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। অর্থদণ্ড পরিশোধ না করলে তাকে আরও তিন মাসের কারাভোগ করতে হবে।
বাল্যবিয়ে সম্পাদন বা পরিচালনা করার শাস্তি
বাল্যবিয়ে নিরোধ আইনের ৯ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বাল্যবিয়ে সম্পাদন বা পরিচালনা করলে তা হবে একটি অপরাধ। এজন্য তিনি সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। অর্থদণ্ড পরিশোধ না করলে তাকে আরও তিন মাস কারাভোগ করতে হবে।
বাল্যবিয়ে নিবন্ধনের শাস্তি
বাল্যবিয়ে নিরোধ আইনের ১১ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো বিবাহ নিবন্ধক বাল্যবিয়ে নিবন্ধন করলে তা হবে একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এজন্য তার সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। অর্থদণ্ডের টাকা পরিশোধ না করলে তাকে আরও তিন মাস কারাভোগ করতে হবে।
বাল্যবিয়ে নিরোধ আইনটি ২০০৯ সালের মোবাইল কোর্ট আইনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা যাবে। অর্থাৎ ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে বাল্যবিয়ে আইনের শাস্তি দেওয়ার বিধান রয়েছে।
এ বিষয়ে আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ জাগো নিউজকে বলেন, বাল্যবিয়ে করলে সর্বোচ্চ শাস্তি দুই বছরের কারাদণ্ড রয়েছে। এই আইন বাস্তবায়ন করলে দেশে বাল্যবিয়ে কমে আসবে।
আইনজীবী জিএম মিজানুর রহমান বলেন, আমাদের দেশে বাল্যবিয়ে দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে যে শাস্তির বিধান রয়েছে, তা অনেকে জানে না। আইনে শাস্তির বিষয়টি সবাইকে জানাতে হবে। বাল্যবিয়ের ক্ষতির বিষয়েও সচেতন করতে হবে। আইনের সঠিক প্রয়োগ হলে দেশে বাল্যবিয়ে কমে আসবে।
আইনজীবী খাদেমুল ইসলাম বলেন, আইনের বাস্তবায়ন হলেই কমবে বাল্যবিয়ে। সরকারের উচিত বাল্যবিয়ে আইনটি বাস্তবায়ন করা। অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনা।
এ বিষয়ে নারী অধিকারকর্মী ও আইনজীবী ফাহমিদা আক্তার বলেন, কন্যাশিশুদের সামাজিক নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে হবে। বাবা-মা কেবল খাওয়া-পরার কষ্টের কারণেই মেয়েশিশুদের বিয়ে দেন তা নয়, সামাজিক অনিরাপত্তাতো স্বাভাবিক। গ্রাম পর্যায়ে স্বাভাবিক সময়ে কন্যাশিশুরা নিরাপদে স্কুল-কলেজে আসা-যাওয়া করতে পারে কি? বখাটেদের উৎপাতসহ নানা কারণে বিরক্ত হয়েও অনেক সময় বাবা-মা তাদের কন্যাসন্তানদের বিয়ে দেন। করোনাকালেও মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার পেছনে নিরাপত্তাজনিত কারণটাও অনেক অভিভাবক উল্লেখ করেন।
তবে আইনের যথাযথ প্রয়োগ বাল্যবিয়ে অনেকাংশে কমিয়ে আনবে এটাই স্বাভাবিক বলে মত দেন তিনি।
জেএ/এইচএ/পিআর