ট্যানারির ‘অসম্পূর্ণ স্থানান্তরই’ চামড়া শিল্প ধসের কারণ
অডিও শুনুন
এবার পানির দরে বিক্রি হয়েছে কোরবানির পশুর চামড়া। অনেকে দাম না পেয়ে চামড়া পুঁতে রেখেছেন আবার কেউ কেউ ফেলেছেন নদীতে। শুধু এবারই নয় গত কয়েক বছর ধরে চামড়ার দামে এ বিপর্যয় চলছে।
জানা গেছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চামড়া রফতানিতে আয় ছিল ১২৩ কোটি মার্কিন ডলার, ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসে তা দাঁড়িয়েছে ৭৩ কোটি ৯৩ লাখ ৯ হাজার মার্কিন ডলারে। অর্থাৎ তিন অর্থবছরের ব্যবধানে চামড়া শিল্পে রফতানি আয় প্রায় অর্ধেকে নেমেছে। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের পর চামড়া শিল্পে কী ঘটেছে, যা এ শিল্পকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে?
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পরিবেশ বান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে ২০০৩ সালে হাজারীবাগ থেকে চামড়া শিল্প নগরী সাভারে স্থানান্তরে প্রকল্প গ্রহণ করে সরকার। তিন বছরের মধ্যে প্রকল্প শেষের কথা ছিল। কিন্তু ১৮ বছর পার হলেও প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি। চতুর্থ দফায় সময় বাড়িয়ে আগামী জুনের মধ্যে প্রকল্প শেষের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রকল্প শেষ না হলেও ২০১৭ সালে উচ্চ আদালত হাজারীবাগের চামড়া কারখানা বন্ধের ঘোষণা দেয়। ফলে সব কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে বেশকিছু চামড়া কারখানার বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ ছিল। এ সনদের সুবাদে তারা জাপান, কোরিয়াসহ ইউরোপ-আমেরিকায় চামড়া রফতানি করতে পারতো। হাজারীবাগে কারখানা বন্ধ হওয়ায় সেই সনদ ও বায়ার (বিদেশি ক্রেতা) হারায় চামড়া শিল্প। অন্যদিকে সাভারের চামড়া শিল্প নগরী পূর্ণাঙ্গভাবে প্রস্তুত না থাকায় এখনও এলডব্লিউজির সনদ লাভ ও নতুন বাজার সৃষ্টি হয়নি। ফলে সনদ না থাকায় চীন ব্যতীত জাপান, কোরিয়াসহ ইউরোপ-আমেরিকায় এলডব্লিউজির ভিত্তিতে চামড়া রফতানি বন্ধ রয়েছে ২০১৭ সাল থেকে। মূলত তখন থেকেই চামড়া শিল্পে ধস নামে।
এ দাবি অবশ্য ট্যানারি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহর। সোমবার (৩ আগস্ট) চামড়া শিল্প নগরীর বর্তমান দুরবস্থার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জাগো নিউজের কাছে এমনটাই দাবি করেন তিনি।
সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, ‘২০১৭ সালের আগ পর্যন্ত চামড়া রফতানিতে অগ্রগতি ছিল। এ শিল্পের কোনো মালিক উল্লেখযোগ্য ঋণ খেলাপি ছিলেন না। আসলে চামড়া শিল্প নগরীর স্থানান্তর যেভাবে হওয়ার কথা ছিল, সেভাবে হয়নি। এ কারণে সিইটিপি (কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার), ডাম্পিং অসম্পূর্ণ রেখে একদিনে হাজারীবাগ থেকে ২২২টি ট্যানারি বন্ধ করা হয়। ফলে যাদের সঙ্গে নিয়মিত ব্যবসা ছিল, সেসব বায়ার চলে যায়। এর একমাত্র কারণ ছিল সাভারের চামড়া শিল্প নগরীর উৎপাদনে যাওয়ার মতো একটা ট্যানারিও প্রস্তুত ছিল না। আবার নতুন করে মার্কেট সৃষ্টির জন্য সিইটিপি বা অন্যান্য পরিবেশ বান্ধব বা এলডব্লিউজির সার্টিফিকেট যে যে ক্যাটাগরির জিনিস দরকার, সেগুলোও ছিল না। যার কারণে সাভারে গিয়ে নতুন বাজারের সৃষ্টি হয়নি। ফলে ২০১৭ থেকে ২০২০ পর্যন্ত চামড়া ব্যবসায় ক্রমেই ধস নামে। এখন কাস্টমার বলতে চীনই কিছু চামড়া নেয়। ইতালি, স্পেন, কোরিয়া বা জাপান সীমিত আকারে নিলেও এলডব্লিউজির সার্টিফিকেট না থাকায় বড় বড় বায়ার আসেনি। এটাই মূল কারণ।’
তবে সাখাওয়াত উল্লাহর বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন সাভার চামড়া শিল্প নগরীর প্রকল্প পরিচালক (পিডি) প্রকৌশলী জিতেন্দ্র নাথ পাল। মঙ্গলবার (৪ আগস্ট) তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘তাহলে তারা (ট্যানারির মালিক) চামড়া কিনছেন কেন? সম্পূর্ণভাবে না কিনলেও তো পারতো। বেচাকেনা ঠিকই হচ্ছে। আগের বছরগুলোতে চামড়া নিত মূলত চীন। আরও কিছু প্রসেসের পর তারা বিক্রি করতো ইউরোপ-আমেরিকায়। ইউরোপে বিক্রি করতে গেলে কোনো কোনো দেশে এলডব্লিউজির সনদ লাগে। ৫৪৩টি কারখানার সেই সনদ আছে। আর সনদ ছাড়া রয়েছে বিশ্বে লাখ লাখ কারখানা।’
জিতেন্দ্র নাথ পাল আরও জানান, ‘বিশ্বে যত চামড়া তৈরি হয় তার মধ্যে ১৫-১৬ শতাংশ সনদপ্রাপ্ত কারখানা থেকে। বাকি ৮৫ শতাংশই কিন্তু সনদপ্রাপ্ত কারখানা থেকে নয়। সব দেশেই যায়, এখনও যাচ্ছে। এলডব্লিউজির জন্য বন্ধ রয়েছে, কথাটা ঠিক নয়।’
এলডব্লিউজির সনদ থাকলে ইউরোপ-আমেরিকায় চামড়া রফতানি করা যেত। সেক্ষেত্রে চামড়ার দাম কিছুটা বাড়তো স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘শিল্প নগরীতে চামড়া প্রসেস হচ্ছে যথাযথভাবেই। কিন্তু এলডব্লিউজির সনদ পেলে ইউরোপ-আমেরিকায় পাঠাতে পারতাম। ফলে চামড়ার দামটা একটু বাড়তো। চামড়ার দামটা সৃষ্টি হয়নি, এটার অন্য কোনো কারণ আছে। প্রত্যেকটা কারখানা নিচ্ছে তো। এমন নয় যে, কোনো কারখানা কম উৎপাদন করছে। যতটুকু উৎপাদনের কথা, প্রত্যেকটা কারখানা ততটুকু করছে। চামড়ার অভাবে সিইটিপি তো বন্ধ নেই। চামড়া প্রসেস না হলে সিইটিপি পুরোদমে প্রসেস হয় কেন?’
চামড়া শিল্প ধসের চিত্র
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চামড়া শিল্পের রফতানি আয় ছিল ১১৬ কোটি ৯ লাখ ৫ হাজার মার্কিন ডলার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ খাতে রফতানি বেড়ে হয় ১২৩ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি। ২০১৫-১৬’র তুলনায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রফতানি বাড়ে ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ।
এরপর থেকেই এ শিল্পের পতন শুরু। ২০১৭ সালে হাজারীবাগ থেকে সাভারে পূর্ণ প্রস্তুতি ছাড়া চামড়া শিল্প স্থানান্তর করা হয়। ফলে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চামড়া শিল্পের রফতানি আয় কমে দাঁড়ায় ১০৮ কোটি ৫৫ লাখ ১ হাজার মার্কিন ডলারে। যা ২০১৬-১৭ অর্থবছরের চেয়ে ১২ দশমিক ০৩ শতাংশ কম।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ শিল্পের রফতানি আরও কমে হয় ১০১ কোটি ৯৭ লাখ ৮ হাজার মার্কিন ডলার। যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরের তুলনায় ৬ দশমিক ০৬ শতাংশ কম।
সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে চামড়া শিল্পের রফতানি আরও কমে হয় ৭৩ কোটি ৯৩ লাখ ৯ হাজার মার্কিন ডলার। যা ২০১৮-১৯ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে চামড়া রফতানি কমেছে ২১ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
‘নিয়মিত রফতানিও কমেছে’
বিটিএর সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, ‘সাভারের সিইটিপির কাজে কিছুটা অগ্রগতি আছে। পাশাপাশি অস্থায়ীভাবে তিনটা ডাম্পিং তৈরি হচ্ছে। এগুলো এখনও অসম্পন্ন। সিইটিপির আনুসঙ্গিক যে কাজগুলো আছে, সেগুলো অতি দ্রুত সম্পন্ন হলে এ পরিস্থিতি আর থাকবে না।’
সিইটিপি হয়তো এ বছর হতে পারে। কোম্পানিকে বুঝিয়ে দেয়া হবে। আর তিনটা ডাম্পিং তৈরি হচ্ছে, মূল ডাম্পিং নয়। এ ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে আমাদের আলাপ হচ্ছে। দ্রুত এর সমাধান দরকার বলেও জানান সাখাওয়াত উল্লাহ।
তিনি আরও বলেন, ‘আসলে আমাদের যে টার্গেট ছিল, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১ দশমিক ২৩ বিলিয়ন মার্কিন (১২৩ কোটি মার্কিন ডলার) ডলার রফতানির। ২০২১-২২ সাল নাগাদ ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে যাওয়ার চিন্তাভাবনা ছিল। চামড়া নগরী যদি সফলভাবে শিফটিংটা হতো, তাহলে টার্গেটের কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব হতো। কিন্তু যেটা রেগুলার ছিল, সেটা থেকেও কমে যাচ্ছি। পরিকল্পিত স্থানান্তরের অভাবে এ অবস্থার তৈরি হয়েছে।’
অস্থায়ী ডাম্পিং থেকেও সনদ পাওয়া সম্ভব
সাভার চামড়া শিল্প নগরীর পিডি প্রকৌশলী জিতেন্দ্র নাথ পাল বলেন, ‘অস্থায়ী বা ইমার্জেন্সি যে ডাম্পিং করা হচ্ছে, সেটা সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে শেষ হবে। অস্থায়ী এ ডাম্পিংগুলোর পর স্থায়ী ডাম্পিং করা হবে। এটা দিয়েই এলডব্লিউজির সনদ পাওয়া সম্ভব। সিইটিপিতে পুরোপুরি কাজ চলছে। ফিনিশিং কিছু বাদ আছে। এ জন্য ফাংশন করতে সমস্যা নেই। সিইটিপির মূল কাজ বর্জ্য পরিশোধন করা, সেটা করা হচ্ছে। গত কয়েক মাস থেকে পরিপূর্ণভাবে সিইটিপি চালু রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘হাজারীবাগ থেকে সাভারে পরিপূর্ণভাবে যেটা পাওয়ার কথা, হস্তান্তর করতে হয়তো আগামী ডিসেম্বর লাগবে। অর্থাৎ, ঠিকাদার হিসেবে চীনের কাজ শেষ হয়ে গেছে। কিছু ফিনিশিং এবং অফিসিয়াল কাজ বাকি। সবকিছু পরীক্ষা করে হস্তান্তর করবে তারা। তাদের কাজ শেষ হবে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের মধ্যে।
ডিসেম্বর নাগাদ চীনাদের কাছ থেকে বুঝে নেব। এরপর ট্যানারি কোম্পানির কাছে পরিপূর্ণভাবে হস্তান্তর করবো। আগামী বছরের শুরুতে আমরা ট্যানারি ভালোভাবে পেয়ে যাব। প্রজেক্ট এর মধ্যেই শেষ হবে। তবে করোনার কারণে প্রজেক্টের মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে।’
পিডি/এএইচ/পিআর