বন্যার পানি ঢুকে গেছে বাড্ডা-রামপুরা পর্যন্ত
অডিও শুনুন
টিনের ঘরের দরজায় হার্ডবোর্ডজাতীয় কিছু একটা বসাচ্ছিলেন হালিমা। পাশে তার মেয়ে ও নাতি। নাতি যেন দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে না যেতে পারে, তাই দরজায় হার্ডবোর্ড বসাচ্ছিলেন হালিমা। কারণ বন্যার পানি চলে এসেছে ঘরের দরজা পর্যন্ত।
রাজধানীর ডেমরা থানার কোনাপাড়ায় এ ভাড়া ঘরের বাসিন্দা হালিমা জাগো নিউজকে বলেন, ‘আগে আশপাশে কোনো পানি আছিল না। একবারে উঁচা আছিল সব। এহন প্রতিদিনই বাড়তাছে। পানি আইছে এক সপ্তাহের উপরে অইবো। পানি বাড়তেই আছে। পানি বাড়তে বাড়তে ঘর পর্যন্ত আইয়া পড়ছে। ওই (রান্না ঘর দেখিয়ে) ঘর একেবারে পানিতে ভইরা গেছে। এই (থাকার) ঘর একটু হুকনা (শুকনো)। মাইঝা রাইতে কী অয়, কইতে হারি না। আগে রান্নাঘর ওই রুমে ছিল। এহন ডুইবা গেছে। ঘুরের মধ্যে রান্দি (রান্না করি)।’
তিনি বলেন, ‘আলাদা ঘরও লইতে পারতাছি না। এক মাসের লেইগা কেউ ঘর দিবো? পানি কবে যায় না-যায় ঠিক আছে?’
কোনাপাড়া বাজারেরও বিভিন্ন দোকানপাট, বাড়ি ও ভবনে বন্যার পানি ঢুকে গেছে। কোনাপাড়ার নতুন ঢালাই করা রাস্তা দিয়ে অল্প সামনে এগোলে দেখা যায়, ওই এলাকার সব ভবন, দোকানপাট ও বাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে। অনেকে যাতায়াত করছেন নৌকায়।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘কেবল কোনাপাড়া নয়, ঢাকার পূর্ব দিকে ডেমরা, জুরাইন, মাদারটেক, খিলগাঁও, বাড্ডা, সাঁতারকুল—এসব অঞ্চলগুলোর যে নিচু এলাকা আছে, সেখানে পানি উঠেছে। এগুলোতে মূলত বালু নদী ও শীতলক্ষ্যার পানি প্রবেশ করেছে।’
রাজধানীর ডেমরা এলাকার বাসিন্দারা জানান, ১৯৯৮ সালের পর ঢাকায় এমন বন্যা হয়নি। অনেক বাড়িঘরে পানি ঢুকে গেছে। কোনো কোনো এলাকায় বন্যার পানি প্রবেশ করেছে, ১০ দিনের বেশি হয়েছে। আবার কোথাও কোথাও সপ্তাহখানেক হলো বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। এসব এলাকার অনেক জায়গায় বাড়িঘরে পানি প্রবেশ না করলেও আশপাশে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে।
এই বন্যা পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষ। তাদের ভাড়া করা কাঁচা কিংবা আধা-কাঁচা ঘরগুলোই বেশি তলিয়েছে বন্যার পানিতে। বন্যায় ভোগান্তির শিকার এসব মানুষের অভিযোগ, সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা করা হচ্ছে না। এমনকি তাদের খোঁজ-খবরও নেয়া হচ্ছে না।
স্থানীয়রা বলছেন, প্রতিদিনই বন্যার পানি বাড়ছে। এমনকি বুধবারও (২৯ জুলাই) বন্যার পানি বেড়েছে। স্থানীয়দের এমন দাবির সঙ্গে নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভূঁইয়ার বক্তব্যের মিল নেই। তিনি বলেন, ‘এখন যে অবস্থায় আছে ঢাকার বন্যা, এর চেয়ে বেশি অবনতি হওয়ার আশঙ্কা নেই। এ সপ্তাহটা থাকবে বন্যা পরিস্থিতি। তারপর আগামী সপ্তাহ থেকে কমতে শুরু করবে।’
এদিকে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র এক পূর্বাভাসে বলেছে, জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে বাংলাদেশ ও উজানের অববাহিকার অনেক স্থানে বৃষ্টিপাতসহ কিছু স্থানে ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টি হয়েছে। ফলে দেশের প্রধান নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বিভিন্ন স্থানে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বর্তমানে উজানের অংশে ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টিপাত প্রবণতা কমে এলেও আবহাওয়ার সাম্প্রতিক পূর্বাভাস অনুযায়ী, চলতি সপ্তাহে উজানের অববাহিকায় অনেক স্থানে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া চলতি সপ্তাহে চন্দ্রপঞ্জিকানির্ভর জোয়ার-ভাটাজনিত কারণে নদনদীর পানি সাগরে নিষ্কাশিত হয়ে হ্রাস পাওয়ার প্রবণতা কিছুটা ধীর হয়ে আসতে পারে। ফলে দেশের প্রধান নদ-নদীর পানি চলতি সপ্তাহে সামগ্রিকভাবে স্থিতিশীল থাকতে পারে। আগস্টের প্রথম সপ্তাহে প্রধান নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করতে পারে। আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে দেশের বন্যাকবলিত অঞ্চলগুলোর বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
কেমন আছেন ডেমরা-কোনাপাড়ার বাসিন্দারা?
বনশ্রী থেকে ডেমরার দূরত্ব প্রায় ৯ কিলোমিটার। বনশ্রী থেকে ২-৩ কিলোমিটার যাওয়ার পর রাস্তার দু’ধারে পানি। কোথাও পানি প্রবেশ করেছে বাড়িঘরে। আবার কোথাও বাড়ির আশপাশের জায়গায় স্থায়ীভাবে জমে আছে পানি। ডেমরা পর্যন্ত প্রায় একই চিত্র।
ডেমরা বাজারে যখন বাসটা থামলো, তখন ঝুম বৃষ্টি হচ্ছিলো। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই নেমে একটি মার্কেটে আশ্রয় নিতে হলো। ততক্ষণে বেলা ১১টা পার হয়ে গেছে। প্রায় ২০ মিনিট পেরিয়ে গেল, কিন্তু বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ নেই। বোঝা গেল, এ বৃষ্টি সহজে থামবার নয়। একটা ছাতা কিনে হাঁটা শুরু।
ডেমরা বাজারের পাশেই লতিফ বাওয়ানী জুট মিলসের কোয়ার্টার। মূল সড়ক থেকে কোয়ার্টারের মাঝখানে অনেক জায়গা। সেই জায়গাটুকু পানিতে ভরা। সড়ক থেকে দেখে মনে হলো, কোয়ার্টারেও পানি প্রবেশ করেছে। সেখানকার দু-একজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, কোয়ার্টারের কিছু জায়গায় পানি প্রবেশ করেছে।
এরপর মিনিট দেড়-দুয়েক হাঁটতেই চোখে পড়ল ওভারহেড বিলবোর্ড। তাতে লেখা—‘সুলতানা কামাল ব্রিজ, ডেমরা’। বিলবোর্ডের অল্প সামনেই সেতুটি। ফুটপাত ধরে সেতুটির মাঝখানে গিয়ে নদীর দিকে তাকাতেই মনে হচ্ছিল যেন আকাশ থেকে কুয়াশা পড়ছে। তবে সবকিছু প্রায় স্পষ্টই দেখা যাচ্ছিল। বোঝা যাচ্ছিল, নদীর এখন ভরা যৌবন। তীর ডুবে না গেলেও নদীর গাঁ ঘেঁষে যেসব দোকানপাট বা স্থাপনা গড়ে উঠেছে, সেগুলোতে পানি প্রবেশ করেছে। সুলতানা কামাল সেতুর কাছেই মিলিত হয়েছে শীতলক্ষ্যা ও বালু নদী। বালু নদীর প্রবাহ এখানেই শেষ। দুই নদী মিলিত হওয়ার পর বয়ে যাওয়া একক প্রবাহের নাম শীতলক্ষ্যা।
সেতুটি থেকে নিচে নামার সিঁড়ি রয়েছে। সিঁড়ি বেয়ে নামার পর নদীর পাড়ে কয়েকজনকে আলাপে মগ্ন দেখা গেল। তাদের একজন মো. নোয়াব আলী। তিনি এখানকার স্থানীয়। ডেমরা এলাকার বন্যা পরিস্থিতির কথা জানতে চাইলে নোয়াব আলী বলেন, ‘এই এলাকায় বালু নদীর পানি ঢুকছে। ঠুলঠুইলা, কায়েতপাড়া, গুদপুড়া, কলাপাড়া—ওই দিকে পানি ঢুকছে। ওইদিকে বাইদগা, মানিকদা, তেরমুনি—এসব এলাকায় বন্যার পানি ঢুকছে। এক সপ্তাহের বেশি হলো এলাকায় পানি ঢুকছে, কমে না। বাড়তেই আছে। আজকেও পানি বাড়ছে, তবে অল্প। ১৯৯৮ সালের পরে এরকম তো পানি হয় নাই।’
ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার থেকে যাত্রাবাড়ীর কোনাপাড়া পর্যন্ত লেগুনা ভাড়া ১০ টাকা। লেগুনায় যাওয়ার সময় রাস্তার দুই পাশেই পানির দেখা মেলে। এ পানি নিচু জায়গার স্থাপনা, বাড়ি ও দোকানপাটে প্রবেশ করেছে। অনেক জায়গায় বাড়িঘরে পানি না ঢুকলেও আশপাশে জলাবদ্ধতা দেখা গেছে।
কোনাপাড়া বাজারে পৌঁছার পর দেখা যায়, এ বাজারেরও বিভিন্ন দোকানপাট, বাড়ি ও ভবনে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। কোনাপাড়ার নতুন ঢালাই করা রাস্তা দিয়ে অল্প সামনে এগোলে বন্যার আরও মারাত্মক চিত্র চোখে পড়ে। বন্যায় এ এলাকার অধিকাংশ বাড়িঘরে পানি প্রবেশ করেছে। অনেকে নৌকায় চলাচল করছেন। কেউ কেউ ছোট সাঁকো বানিয়ে যাতায়াত করছেন। অনেক সময় সাঁকোতেও শেষ রক্ষা হচ্ছে না। কোমর পানি ঠেলে প্রবেশ করতে হচ্ছে ঘরে। সবমিলিয়ে এ এলাকার মানুষের ভোগান্তি চরমে।
প্রায় ২০ বছর ধরে কোনাপাড়া এলাকায় থাকেন মো. রাসেল। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘ধার্মিকপাড়া, মল্লিকপাড়া, সুংড়াডেঙ্গা, আমুইল্লা, মানিকদা, আরও আশেপাশে জায়গা আছে—সব ডুইব্যা গেছে। এই পাশে যাত্রাবাড়ীরও বিভিন্ন জায়গা ডুবে গেছে। যাত্রাবাড়ীর কাজলা, মিদ্যাবাড়ি, কাউন্সিল—এগুলো ডুইব্যা গেছে।’
কোনাপাড়া থেকে ফের ডেমরা অভিমুখে যাত্রা। ডেমরা থেকে বনশ্রী হয়ে এবার বাসায় ফেরার পালা। একটি বাসে করে ফেরার পথে রাস্তার দু’ধারে পানি দেখে খিলগাঁও থানার উত্তর মানিকদার নাগদারপাড়ে নামতে হলো। বাস থেকে বন্যার যে চিত্র দেখা যাচ্ছিল, নামার পর তা আরও প্রকট মনে হলো। পাশেই নাগদারপাড় সেতু। সেতুর উভয়পাশে অনেক পাকা বা কাঁচা বাড়ি বন্যার পানিতে অর্ধেক ডুবে গেছে। সেখানকার এক কিশোর বলে, ‘এবার পানি অনেক বেশি’।
পিডি/এইচএ/এমএস