কৃষির পুনর্বাসনে কর্মকর্তাদের প্রতি কঠোর নির্দেশনা
অডিও শুনুন
চলমান বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষি খাত। এ খাতের ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন এবং ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় সব কর্মকর্তাকে তৎপর থাকতে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, দিন দিন বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। কৃষিতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বাড়ছে। বন্যার পানি নেমে গেলে জরুরিভিত্তিতে কৃষি পুনর্বাসন ও ক্ষয়ক্ষতি কমাতে কাজ করতে হবে।
মন্ত্রী আমনের জন্য দ্রুত বিকল্প বীজতলা তৈরিরও নির্দেশনা দেন। তিনি বলেন, বীজ, সারসহ কৃষি উপকরণের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। এসব বীজ ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মাঝে বিতরণ করে দ্রুত নতুন বীজতলা তৈরি করতে হবে।
এছাড়া রবি মৌসুমের জন্যও ব্যাপক আগাম প্রস্তুতির কথা জানান কৃষিমন্ত্রী। সেজন্য কর্মকর্তাদের অত্যন্ত তৎপর, সজাগ ও সক্রিয় থাকতে হবে।
কৃষিমন্ত্রী বুধবার তার সরকারি বাসভবন থেকে কৃষি মন্ত্রণালয় ও এর অধীনস্থ সংস্থার মধ্যে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি (এপিএ) স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে অনলাইনে এসব কথা বলেন।
মন্ত্রী বলেন, বন্যায় ক্ষতি কমাতে ইতোমধ্যে কৃষির সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর সবধরনের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ২৮টি জেলার চাষিদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বীজ, সারসহ বিভিন্ন প্রণোদনা কার্যক্রম বেগবান, তদারকি ও সমন্বয়ের জন্য ১২টি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা ঈদের পরদিন থেকে বন্যাপ্লাবিত এলাকার কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়মিতভাবে অনলাইন মিটিং ও সরেজমিন পরিদর্শনের মাধ্যমে মাঠের সব কার্যক্রম নিবিড়ভাবে তদারকি ও মনিটরিং করবেন— এমন নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে।
সচিব মো. নাসিরুজ্জামান বলেন, কৃষির সব কর্মকর্তা-কর্মচারী মহামারি করোনার প্রকোপের শুরু থেকেই খাদ্য উৎপাদনের বর্তমান ধারা অব্যাহত রাখা এবং তা আরও বাড়াতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। ঘূর্ণিঝড় আম্পান ও চলমান বন্যার কারণে কৃষিতে ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায়ও তারা কৃষকের পাশে থেকে কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন।
তিনি বলেন, আমনের বীজতলা তৈরিতে সবধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেই বীজতলা তৈরি করা হবে।
সভায় কৃষি মন্ত্রণালয় ও এর অধীনস্থ ১৭টি সংস্থা/দফতরের মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরের বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কৃষি সচিব মো. নাসিরুজ্জামান। সঞ্চালনা করেন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) মো. আরিফুর রহমান অপু। বিশেষজ্ঞ পুলের সদস্য কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রাক্তন সচিব ড. এস এম নাজমুল ইসলাম, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আব্দুস সাত্তার মণ্ডল, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক মো. হামিদুর রহমান, মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও সংস্থাপ্রধানগণ এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
ভারী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পানির কারণে দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে বন্যা দেখা দিয়েছে। গত ২৬ জুন থেকে বন্যা শুরু হয়, এরপর পরিস্থিতির কিছু উন্নতি হলেও ১১ জুলাই থেকে দ্বিতীয় দফায় পানি বাড়ে। সর্বশেষ ২১ জুলাই থেকে তৃতীয় দফায় পানি বাড়ছে। এই বন্যা আরও কিছুদিন থাকতে পারে বলে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকে জানানো হয়েছে।
প্রথম পর্যায়ের বন্যায় প্রায় ৩৪৯ কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছে জানিয়ে কৃষিমন্ত্রী সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘বন্যায় আউশ, আমন, সবজি, পাটসহ বেশ কিছু ফসলের অনেক ক্ষতি হয়েছে। বিকল্প বীজতলা তৈরি, ক্ষতিগ্রস্ত জমিতে বিকল্প ফসল চাষের ব্যবস্থা, নিয়মিতভাবে আবহাওয়া মনিটরিংসহ প্রস্তুতি চলছে যাতে বন্যার কারণে ফসলের ক্ষতি মোকাবিলা করা যায়।’
এদিকে চলমান বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রান্তিক কৃষকদের চার স্তরে ৭ কোটি ১৯ লাখ ৮ হাজার টাকার প্রণোদনা দেবে সরকার। কমিউনিটিভিত্তিক রোপা আমন ধানের চারা উৎপাদন, ভাসমান বেডে রোপা আমন ধানের চারা উৎপাদন, রোপণ যন্ত্রের (ট্রান্সপ্ল্যান্টার) মাধ্যমে রোপণের জন্য ট্রেতে নাবী জাতের আমন ধানের চারা উৎপাদন ও তা ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ এবং মাসকলাইয়ের বীজ বিতরণ— এ চারটি মাধ্যমে ৮৮ হাজার ৩১ জন কৃষককে প্রণোদনা দেয়া হবে।
কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে এ তথ্য জানা গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২ কোটি ১৪ লাখ টাকার কমিউনিটিভিত্তিক রোপা আমন ধানের চারা পাবেন ৩৫ হাজার ১৬৬ জন কৃষক। ভাসমান বেডে রোপা আমন ধানের চারা উৎপাদন ও বিতরণে এক হাজার ২৬৫ জন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক পাবেন ৬৯ কোটি টাকার প্রণোদনা। এছাড়া রোপণ যন্ত্রের মাধ্যমে রোপণের জন্য ট্রেতে নাবী জাতের আমন ধানের চারা উৎপাদন করে তা এক হাজার ৬০০ ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করা হবে, এতে সরকারের ব্যয় হবে ৫৪ লাখ ৮ হাজার টাকা। ৫০ হাজার কৃষককে বিনামূল্যে মাসকলাইয়ের বীজ বিতরণ করা হবে, এতে ব্যয় হবে ৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা।
বুধবার সরকারের এক তথ্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, অতিবর্ষণের কারণে সৃষ্ট বন্যায় দেশের ৩১ জেলায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে মানবিক সহায়তা হিসেবে বিতরণের জন্য এখন পর্যন্ত ১২ হাজার ৭১০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। যার মধ্যে সাত হাজার ৬৩০ মেট্রিক টন চাল বিতরণ হয়েছে।
দেশের বন্যাকবলিত জেলাসমূহ হচ্ছে- ঢাকা, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, মুন্সিগঞ্জ, রাজবাড়ী, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, জামালপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, রংপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ এবং সুনামগঞ্জ। বন্যাকবলিত উপজেলার সংখ্যা ১৫৪ এবং ইউনিয়ন ৯১৭টি। পানিবন্দি পরিবারের সংখ্যা ১০ লাখ ২১ হাজার ৮৩৪ এবং ক্ষতিগ্রস্ত লোক সংখ্যা ৪৮ লাখ ৫৬ হাজার ৬২৮ জন।
বন্যায় এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৪১ জন। এর মধ্যে জামালপুরে ১৫, লালমনিরহাটে ১, সুনামগঞ্জে ৩, সিলেটে ১, কুড়িগ্রামে ৯, টাঙ্গাইলে ৪, মানিকগঞ্জে ২, মুন্সীগঞ্জে ১, গাইবান্ধায় ১, নওগাঁয় ২ এবং সিরাজগঞ্জে ২ জন রয়েছেন।
এমইউএইচ/এমএআর/পিআর