রায়হান কবির ইস্যুতে সোচ্চার মানবাধিকার সংগঠন, নীরব ঢাকা

জেসমিন পাপড়ি
জেসমিন পাপড়ি জেসমিন পাপড়ি , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৪:৫৮ পিএম, ২৬ জুলাই ২০২০
বাংলাদেশি তরুণ রায়হান কবিরকে গ্রেফতারের পর ১৪ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন বিভাগ

অডিও শুনুন

মালয়েশিয়ায় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল-জাজিরায় প্রচারিত একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে কথা বলার অপরাধে বাংলাদেশি তরুণ রায়হান কবিরকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়েছে সেখানকার ইমিগ্রেশন বিভাগ। তার মুক্তির বিষয়ে দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলো সোচ্চার হলেও নীরব ভূমিকায় ঢাকা। সরকারের সংশ্লিষ্টরা শুরু থেকেই বলে আসছেন, একজন বাংলাদেশির জন্য মালয়েশিয়ার সঙ্গে কোনো ধরনের ‘কনফ্লিক্টে’ যাবে না বাংলাদেশ।

অভিবাসী অধিকার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠনের প্রতিনিধিরা বলছেন, যে রেমিট্যান্সযোদ্ধারা দেশের অর্থনীতিকে সচল রেখেছেন তাদের জন্যই কথা বলে অন্যায়ভাবে গ্রেফতার হয়েছেন রায়হান কবির। দেশের একজন নাগরিকও অন্যায়ভাবে নিগৃহীত হলে তার পাশে রাষ্ট্রকে দাঁড়াতে হবে। এভাবে শুধু গণমাধ্যমে কথা বলার অপরাধে মালয়েশিয়া কাউকে গ্রেফতার করতে পারে না।

এ বিষয়ে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেন, শুধু একজন বাংলাদেশির জন্য মালয়েশিয়ার সাথে কোনো ধরনের ‘কনফ্লিক্টে’ (বিরোধ বা সংঘাত) যাবে না বাংলাদেশ

তাহলে বাংলাদেশ ব্যাপারটি নিয়ে কী করছে জানতে চাইলে মন্ত্রী জানান, বিষয়টি নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে আলোচনা করা হবে।

প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী বলেন, এ ধরনের ইস্যুগুলো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভালোভাবে দেখভাল করতে পারে। তারাই দেখে এসব বিষয়। তারা বিষয়টি সে দেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কথা বলে দেখতে পারে। আগামী সপ্তাহে আমাদের একটি মিটিং হবে, আমি সেখানে প্রসঙ্গটি তুলবো। দেখা যাক কী করা যায়।

ইমরান আহমদ মনে করেন, ‘যে দেশে যেমন আইন সে দেশে সেভাবে আচরণ থাকা উচিত। বাংলাদেশে যা করা যাবে বিদেশে তা না-ও করা যেতে পারে।’

অভিবাসী অধিকারকর্মীরা যা বলছেন
রায়হানের বিষয়ে অভিবাসী বিশ্লেষকেরা বলছেন, রায়হান কবির মালয়েশিয়ার আইন ভাঙেননি। সাক্ষাৎকার দেয়ার অপরাধে একজন অভিবাসী নন শুধু, কাউকেই গ্রেফতার করা যায় না।

বিশ্বের বৃহত্তম সংস্থা ব্র্যাকের মাইগ্রেশন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, করোনা পরিস্থিতির মধ্যেই কিন্তু অনেক বাংলাদেশি মালয়েশিয়া থেকে ফেরত এসেছেন। এদের অনেকেই কিন্তু নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছেন এবং নির্যাতনের কোনো মাত্রা নেই। এসব নির্যাতনের ঘটনার একটি প্রতিফলন কিন্তু আল জাজিরার প্রতিবেদনে দেখা গেছে। কিন্তু আমরা কখনো দেখিনি যে এই ধরনের ঘটনায় আমাদের রাষ্ট্র শক্ত কোনো প্রতিবাদ করেছে। যেসব ভুক্তভোগীদের কথা সামনে আসছে আমাদের রাষ্ট্রদূত কিংবা দূতাবাসের কর্মকর্তারা কি কখনো জানতে চেয়েছেন, কেন উলঙ্গ করে নির্যাতন করা হয়েছে?

তিনি বলেন, কয়েক লাখ কর্মী আছে মালয়েশিয়ায়, শ্রমবাজারের কথা চিন্তা করে কিছু বলি না। বারবার এগুলা ভাবতে গিয়ে আমরা সবসময় কর্মী নিপীড়নের কথা এড়াতে চাই। শুধু বাংলাদেশ নয়, কোনো দেশের ঘটনায়ই আমরা শক্তভাবে কিছু বলতে পারি না। একটি ছেলে সাক্ষাৎকার দেয়ায় পুরো বাংলাদেশ কমিউনিটিকে যেভাবে হেয় করা হচ্ছে, ওয়ার্ক পারমিট বাতিল করা হচ্ছে, এগুলো কিন্তু কোনো আইনের মধ্যেই পড়ে না।

jagonews24

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ (ফাইল ছবি)

শরিফুল হাসান বলেন, এই একই সাক্ষাৎকারে আরও অন্য দেশের নাগরিকদের বক্তব্যও আছে। তাদের বিরুদ্ধে তো কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। রায়হানের ছবি প্রকাশ করে পুলিশ তাকে খুঁজেছে। তাকে দেশে ফেরত পাঠাবে বলে ওয়ার্ক পারমিট বাতিল করেছে। তারা বাংলাদেশিদের সঙ্গে এরকম করতে পারে, কারণ তারা জানে যে এরকম করলে কেউ কোনো প্রতিবাদ করবে না। যার কারণে এই ঘটনাগুলো ঘটে।

‘রায়হানের সঙ্গে যা ঘটেছে তা একেবারের অন্যায় হয়েছে। আমাদের সবার উচিত রায়হানের পাশে থাকা, কারণ রায়হান যা বলেছে তা কোটি প্রবাসীর পক্ষে কথা বলেছে। সত্য বলার কারণে আইন ভেঙে মালয়েশিয়া তাকে যেভাবে গ্রেফতার করেছে, ওয়ার্ক পারমিট বাতিল করেছে, সেটা কখনোই গ্রহণযাগ্য নয়। আর রায়হান নিজের একার কথা কিন্তু বলেনি। সেখানে বছরের পর বছর এভাবে নির্যাতন চলছে’—বলেন ব্র্যাকের এই কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, আমার কাছে মনে হয় বাংলাদেশ চাইলে মালয়েশিয়ার কাছে ব্যাখ্যা চাইতে পারতো বা জানতে চাইতে পারতো বা মালয়েশিয়া ঘটনার তদন্ত করতে পারতো। তা না করে অভিবাসীদের যে মর্যাদার আইন, সেটা তারা ভেঙেছে। জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক অভিবাসীদের সংগঠন, ১৯৯০-এর কনভেনশনে যারা স্বাক্ষর করেছে, তাদের সবারই উচিত রায়হানের পাশে থাকা।

এদিকে, রায়হান কবিরের মুক্তির দাবি জানিয়ে গতকাল শনিবার (২৫ জুলাই) যৌথ বিবৃতি দিয়েছে ২১টি সংগঠন। সংগঠনগুলো হলো- রামরু, ওয়ারবি, ব্র্যাক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ), ওকাপ, বিএনএসকে, আইআইডি, আসক, বমসা, বাসুগ, ইনাফি, কর্মজীবী নারী, বিএনপিএস, ডেভকম, ইমা, আওয়াজ ফাউন্ডেশন, রাইটস যশোর, বিলস, বাস্তব, ফিল্মস ফর পিস ফাউন্ডেশন।

তারা এ ব্যাপারে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশন, ঢাকার পররাষ্ট্র ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সক্রিয় হওয়ার অনুরোধ করেছে।

মালয়েশিয়ায় লকডাউন চলাকালে অভিবাসীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার নিয়ে আল-জাজিরার ‘১০১ ইস্ট প্রোগ্রাম’র একটি পর্বে সম্প্রতি সাক্ষাৎকার দেন বাংলাদেশি রায়হান কবির। ‘লকডআপ ইন মালয়েশিয়া’স লকডাউন’ শিরোনামের ওই পর্বে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে রেড জোনে অভিযান চালানোর সময় মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ও সমালোচনা তুলে ধরা হয়।

সেই সাক্ষাৎকার দেয়ায় মালয়েশিয়া কর্তৃপক্ষ রায়হান কবিরের ওয়ার্ক পারমিট বাতিল করে এবং তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। তাকে গত ২৪ জুলাই বিকেলে কুয়ালালামপুরের জালান পাহাংয়ের একটি এলাকা থেকে গ্রেফতার করে সেখানকার নিরাপত্তা বাহিনী। ২৫ জুলাই দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমির হামজা জয়নুদ্দিন সাংবাদিকদের জানান, রায়হান কবিরকে ১৪ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে ইমিগ্রেশন বিভাগ

জেপি/এইচএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।