পদ্মায় বিলীন ‘চরের বাতিঘর’

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি মাদারীপুর
প্রকাশিত: ০৬:৫৭ পিএম, ২৩ জুলাই ২০২০

মাদারীপুরের শিবচরের বন্দরখোলা। সরকারের নানা পদক্ষেপে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছিল এই চর ইউনিয়নের মানুষের যাপিত জীবনে। এই চরে বিদ্যুৎ, চিকিৎসা, পাকা সড়ক— সব ধরনের অবকাঠামো গড়ে উঠেছিল। ছড়াচ্ছিল শিক্ষার আলোও। কিন্তু গত কয়েক বছরে ‘কীর্তিনাশা’র ভাঙন সব কেড়ে নিচ্ছে বন্দরখোলাবাসীর। এবার পদ্মার গ্রাসে হারিয়ে যাচ্ছে ‘চরের বাতিঘর’ খ্যাত বন্দরখোলার মডেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এস ই এস ডি পি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়। আধুনিক সুযোগ-সুবিধার প্রতিষ্ঠানটি এভাবে বিলীন হতে দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন চরাঞ্চলের বাসিন্দারা। অনেক শিক্ষার্থীকে কাঁদতেও দেখা গেছে।

বুধবার (২২ জুলাই) মধ্যরাতে নূরুদ্দিন মাদবরেরকান্দি গ্রামে অবস্থিত বিদ্যালয়টির তিনতলা ভবনের মাঝ বরাবর দ্বিখণ্ডিত হয়ে হেলে পড়ে। বৃহস্পতিবার (২৩ জুলাই) এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বিদ্যালয়টি নদীর দিকে আরও হেলে পড়েছে। যেকোনো মুহূর্তে এটি পুরোপুরি বিলীন হয়ে যেতে পারে পদ্মায়।

২০০৯ সালে স্থাপিত প্রতিষ্ঠানটিতে শিবচরের বন্দরখোলার মমিন উদ্দিন হাওলাদারকান্দি, জব্বার আলী মুন্সীকান্দি, বজলু মোড়লের কান্দি, মিয়া আজম বেপারীর কান্দি, রহমত হাজীর কান্দি, জয়েন উদ্দিন শেখ কান্দি, মসতখাঁর কান্দিসহ প্রায় ২৪টি গ্রাম এবং ফরিদপুর জেলার সদরপুর উপজেলার চর নাসিরপুরসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের ছেলে-মেয়েরা পড়ালেখা করছিল। চরাঞ্চলে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত দৃষ্টিনন্দন এ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় চারশ।

jagonews24

বিদ্যালয়সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীদের সবাই চরের বাসিন্দা। মূল ভূখণ্ড এখান থেকে বেশ দূরে হওয়ায় চরের ছেলে-মেয়েরা অন্যত্র গিয়ে লেখাপড়া করার সুযোগ পেত না। এই বিদ্যালয় গড়ে ওঠার কারণে শিক্ষার আলোয় আলোকিত হওয়ার সুযোগ আসে তাদের সামনে।

স্থানীয়রা জানান, পদ্মার নিকটবর্তী হওয়ায় প্রতি বছরই বন্যার পানিতে ডুবে যেত বিদ্যালয়সহ আশপাশের এলাকা। গত বছর পদ্মা ভাঙতে ভাঙতে পেছন দিক দিয়ে বিদ্যালয়টির কাছে চলে আসে। এরপর গত বছরই জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরীর নির্দেশে ওই এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ড জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন ঠেকায়। চলতি বর্ষা মৌসুমেও ভাঙন ঠেকাতে জিও ব্যাগ ডাম্পিং চলতে থাকে ওই এলাকায়। তবে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রচণ্ড স্রোতের কারণে জিও ব্যাগ ফেলে তেমন সুবিধা করতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। ফলে বুধবার রাতে তিনতলা ভবন হেলে পড়তে শুরু করে।

jagonews24

এ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী ফয়সাল বলে, বিদ্যালয়টি নদীতে তলিয়ে গেলে এলাকায় হয়তো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হবে। কিন্তু এটির মতো আধুনিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাবে না কি-না, বলা যায় না। এই বিদ্যালয়টির পাশাপাশি কাজির সুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টিও নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে। এই দুটি প্রতিষ্ঠানই পাকা ভবন। এ দুটিই আমাদের এলাকার ছেলে-মেয়েদের প্রিয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কিন্তু পদ্মা আমাদের আলোর প্রতিষ্ঠান কেড়ে নিচ্ছে।

বন্দরখোলা ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নং ওয়ার্ডের সদস্য (মেম্বার) মো. ইসমাইল বলেন, বুধবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে হঠাৎ করেই বিকট শব্দ হতে থাকে স্কুল ভবনের মধ্য থেকে। খবর পেয়ে অসংখ্য মানুষ ট্রলারে করে বিদ্যালয়টি দেখতে আসে। আমাদের সামনেই বিদ্যালয়টির মাঝখানে ফাটল ধরে এবং এটি পেছন দিকে হেলে পড়ে। বিদ্যালয়টিতে ভাঙন ধরলে এলাকাবাসী কান্নায় ভেঙে পড়ে। চোখের সামনে এভাবে বিদ্যালয়টি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে দেখে স্থানীয়রা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আফজাল হোসেন জানান, চরের চার শতাধিক শিক্ষার্থীর লেখাপড়ার অনিশ্চিত জীবন শুরু হলো।

jagonews24

শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আসাদুজ্জামান বলেন, বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর এবং করোনার প্রভাবমুক্ত হলে চরে অস্থায়ীভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া চালিয়ে নেয়া হবে।

এদিকে পদ্মায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় চরাঞ্চলে ভাঙনের তীব্রতা বেড়েছে। ঘরবাড়ি ভেঙে নিরাপদ স্থানে ছুটে যাচ্ছে শত শত মানুষ। এছাড়া পানিবন্দি হয়ে পড়েছে হাজার হাজার মানুষ। ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় গবাদি পশু নিয়ে দুর্ভোগে দিন কাটাচ্ছে চরের বাসিন্দারা।

এ কে এম নাসিরুল হক/এইচএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।