লাভ নয়, চালান উঠলেই বাঁচেন পশু ব্যবসায়ী-খামারিরা
অডিও শুনুন
আসন্ন ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন পশুর হাটে গরু ওঠানো শুরু করেছেন ব্যাপারী-খামারিরা। ঢাকার গাবতলীর পশুর হাটসহ রাজধানীতে যে কয়টি হাট অনুমোদন পেয়েছে সেগুলোতেও আর ৫-৬ দিন পরেই পশু উঠতে শুরু করবে। গাবতলীর হাটে ইতোমধ্যেই দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পশু আসতে শুরু করেছে এবং সেখানে বেচাকেনাও হচ্ছে।
গাবতলী ও দেশের বিভিন্ন হাটে পশু ব্যাপারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ পর্যন্ত যেখানে যেখানে হাট শুরু হয়েছে, সেখানে শুধু পশু বিক্রেতারাই উঠছেন। হাজার হাজার পশু উঠছে হাটে, কিন্তু ক্রেতা নেই। ব্যাপারী-খামারি সবাই এক সুরেই বলছেন, ‘এবার লাভ চাই না, চালান নিয়ে ঘরে যেতে পারলেই বাঁচি।’
শুক্রবার (১৭ জুলাই) নরসিংদীর বেলাবো পশুর হাটে দেখা গেছে, পুরো হাট গরু দিয়ে ঠাসা। ক্রেতার চেয়ে বিক্রেতা ১০ গুণ বেশি। এ হাটে শিবপুর থেকে ১০টি গরু নিয়ে এসেছেন আনোয়ার ব্যাপারী। সকাল ১০টায় বাজারে উপস্থিত হয়েছেন, বেলা ৪টা পর্যন্ত বিক্রি করতে পেরেছেন ২টি গরু। তাও সেগুলো প্রায় কেনা দামেই।
আনোয়ার জাগো নিউজকে বলেন, ‘এই সপ্তাহে পুঠিয়া, হাতির দিয়া পশুর হাটেও গিয়েছি। এবার কোরবানির হাটে ব্যবসা হবে না, এটা বোঝা গেছে। ২০ বছরের অভিজ্ঞতায় মনে হচ্ছে, এবার চালান রক্ষা করাই কঠিন হবে।’
নরসিংদীর শিবপুরের পুঠিয়া পশুর হাটে কিশোরগঞ্জ থেকে ১২টি ষাঁড় নিয়ে এসেছেন মান্নান। এগুলো তার খামারের গরু। সারা বছর ধরে খাইয়ে, যত্ন করে বড় করেছেন কিছু টাকা লাভ করবেন বলে। কিন্তু এবার হাটের কোনো গতি বুঝতে পারছেন না তিনি। তার ধারণা, গো-খাদ্যের যে দাম এবং এদের পেছনে যে পরিশ্রম, এবার সবই বৃথা যাবে।
তিনি বলেন, ‘মাংসের দরে (২০ হাজার টাকা মণ) গরু বিক্রি করলে লাভ হবে না। যারা মাংসের গরু তৈরি করে তারা আমাদের মতো এত খরচ করে খাওয়ায় না। দেশের যে অবস্থা তাতে কামনা করছি, চালানটা ঘরে নিতে পারলেই বাঁচি।’
বৃহস্পতিবার (১৬ জুলাই) সকালে সিরাজগঞ্জ থেকে ৭টি গরু নিয়ে গাবতলী হাটে এসেছিলেন আমিনুল ইসলাম নামের এক গরু ব্যাপারী। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘১০টায় হাটে এসে পৌঁছেছি, বিকেল ৪টা পর্যন্ত কোনো গ্রাহক নেই। হাটে এসে শুনলাম, আমার আগে যারা গ্রাম থেকে এসেছিলেন তারা ৫-৬ দিন থেকে লস দিয়ে গরু বিক্রি করে চলে গেছেন।’
তিনি বলেন, ‘এবার গরুর হাট জমবে না। এটা এখন থেকেই টের পাওয়া যাচ্ছে। কারণ প্রতিবার এই সময় গাবতলী গরুর হাট ভরে যায়। এবার এখন পর্যন্ত মূল হাটের চার ভাগের এক ভাগও ভরেনি। প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে যে সব ব্যাপারীরা গরু নিয়ে আসেন, তারা অনেকেই করোনাভাইরাসের কারণে গরুই কেনেননি।’
‘আসছি যখন আর ফিরে যাব না। চালান ওঠার মতো দাম পেলেই বিক্রি করে বাড়ি চলে যাব’, যোগ করেন তিনি।
মানিকগঞ্জ থেকে কেরানীগঞ্জের হযরতপুর পশুর হাটে ৫টি ষাঁড় নিয়ে এসেছেন মানিক। এ গরুগুলো তার খামারে লালন-পালন করেছেন। সারা বছর কোরবানির আশায় থাকলেও হাটে এসে চিত্র দেখে তিনি হতাশ। দুই হাট ঘুরেছেন তিনি। আরও কয়েকটি হাটের বাজার দরের খোঁজ খবরও নিয়েছেন।
গত এক সপ্তাহে বিভিন্ন হাটের খবরাখবর নিয়ে তিনি বলছেন, ‘এবার কপালে লাভ জুটবে না। গরুগুলো সারা বছর পুষতে যে খরচ হয়েছে, সেটা ওঠাতে পারলেই গরু বিক্রি করে চলে যাব। গত বছরও লস হয়েছে, এবার চালান পেলেই খুশি।’
তিনি দুঃখ করে বলেন, ‘গরু পোষা এই বারই শেষ, আর গরু পুষব না।’
ঢাকার গাবতলী হাটেই দীর্ঘদিন গরুর ব্যবসা করেন জমির আলী। তিনি এখান থেকে গরু কিনে এই হাটেই বিক্রি করেন। তিনি বলেন, ‘টেলিভিশনের খবরে এবং ইউটিউব চ্যানেলে দেশের বিভিন্ন স্থানের গরুর হাট দেখছি। দরদাম শুনছি। দেশের বিভিন্ন হাটে গরুর আমদানি দেখে মনে হচ্ছে, এবার মানুষ আর কিছু করেনি, শুধুই গরুই লালন-পালন করেছে। এত গরু আমার জীবনে আমি দেখিনি।’
জমির আলী বলেন, ‘এবার কোরবানির হাট ভালো জমবে না। কোরবানির সংখ্যাও কম হবে। গ্রামগঞ্জের মানুষ এবার গরু কিনছেন না। মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ। এর আগে কিছু গরু কিনেছিলাম। গত ১৫ জুলাই ৪০০ টাকা কেজি দরে মাংস ওজন করে বিক্রি করেছি। আজ বসে আছি, গরু কিনব কি না বাজার বুঝতে পারছি না। গত বছর ২ লাখ টাকা লস করেছি। এবারও লসের ভাগেই পড়ছি। গরু কিনে লাভ করতে পারছি না।’
১১টি গরু নিয়ে কুষ্টিয়া থেকে গাবতলী হাটে এসেছেন রকি নামের এক গরু ব্যাপারী। তিনি বলছেন, ‘গ্রামেও এখন গরু সস্তা, নেয়ার লোক নেই’। যে গরুগুলো তিনি এনেছেন গত বছর এই মাপের গরু তিনি ৬০-৬৫ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। এবার ৪৫-৪৮ হাজারের ওপর দাম ওঠেনি।
রকি বলেন, ‘এই দামে গরু বিক্রি করলে লস হবে। তবে ভাবছি, চালানটা তোলার জন্য। চালান হাতে এলেই গরু বিক্রি করে বাড়ি চলে যাব।’
১২টি গরু নিয়ে চুয়াডাঙ্গা থেকে গাবতলীর হাটে এলেন আলম নামের এক খামারি। নিজের খামারের গরু নিয়ে প্রতিবছরই তিনি গাবতলী হাটে আসেন। তিনি বলেন, ‘এবার গরু নিয়ে এসে কি ভুল করলাম? দু’দিন হয়ে গেল একটি গরুও বিক্রি করতে পারলাম না। গত বছর এমন সময়ে নিজের খামারের ১৫টি গরু বিক্রি করে আবার বাড়ি গিয়ে বড় ভাইয়ের খামারের ১০টি গরু নিয়ে এসে বিক্রি করেছি। লাভ ভালোই হয়েছিল। এবার হাটের হাব-ভাব ভালো লাগছে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘অন্যান্য বছর তিন মাস আগে থেকেই বাড়ি বাড়ি ঘুরে ব্যাপারীরা গরু কিনেছেন। এবার একটা ব্যাপারীও দেখা যায়নি। করোনাভাইরাস নিয়ে সবাই আতঙ্কের মধ্যে আছেন। গত দুই বছরে লাভ করেছি।’ এবার দেশের যে অবস্থা তাতে চালানটা তুলতে পারলেই খুশি এ খামারি।
এফএইচএস/এফআর/এমএস